ঢাকা ১১:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কলাগাছের ভেলাই যেন হাওরে ‘সোনার তরী’

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৪০:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ এপ্রিল ২০১৭
  • ৭৭৭ বার

বেড়িবাঁধ মিঠামইন হাওর থেকে:
হাওরের বিস্তীর্ণ বুকে পানি আর পানি। বুকভরা জলরাশিতে ডুবো ডুবো দুই শিশু সহোদর জিহাদ ও জিয়া।
অন্তত খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে দরিদ্র কৃষক বাবার সঙ্গে ঢলের পানিতে নামতে হয়েছে ওদেরও।
পানিতে ডুবন্ত আধা পাকা ধান যে করেই হোক টেনে তুলতেই হবে। অথচ স্বপ্নভঙ্গের অধ্যায়ে শেষ সম্বলটুকু ঘরে তুলতে অপরিহার্য নৌকা ভাড়া করার সক্ষমতাও নেই।
হা হুতাশের এ সময়ে থই থই পানিতে কলাগাছের ভেলাই তাই দুই ভাইয়ের শেষ ভরসা।
নিজেদের তৈরি এ বাহনেই ভেজা ধানের আঁটি তুলে শহররক্ষা বাঁধের সড়কের টানের দিকে শরীর ভাসিয়ে দিয়েছে ওরা।
পানিতে স্বামীর বোনা স্বপ্ন তলিয়ে যাওয়ার পর নিজ সন্তানদের সংগ্রামে নামার দৃশ্য অসহায় দৃষ্টিতে টানে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মা মেহের বেগমও। সন্তানদের মতোই এ ধান যে তারও জীবন-মরণ।
মিঠামইন উপজেলা সদরের শহররক্ষা বাঁধের পাদসীমায় পাকা সড়ক। সড়কের কোণাঘেঁষে সারি সারি পাকা-আধা পাকা ধানের গাদা। সপ্তাহ দুয়েক আগেও যার সামনে ছিলো সোনা রাঙা ধানের মাঠ।
চৈত্রের অকাল বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে কৃষকের মুঠো মুঠো স্বপ্ন। ফসল হারানোর হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে মোড়া তাই এ বেড়িবাঁধ লাগোয়া গ্রামগুলো। বছরের একমাত্র ফসল বিলীন হওয়ায় অসহায় মানুষজনের মাথায় ভেঙে পড়েছে নীলাকাশ।
বুক সমান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা ধানের থোড়া কেটে আনতে পদে পদে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
ফসল কাটতে ভোরবেলাতেই ভিজে টইটুম্বর ভাগ্যবিড়ম্বিত কৃষকদের জীবন সংগ্রামের চিত্রকল্পেরই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে বেড়িবাঁধও।
তাদের মতোই হাওরের ভয়ঙ্কর থাবায় জিহাদ ও জিয়ার ভাগ্যাকাশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। প্রায় দুই একর ফসল হারিয়েছেন ওদের বাবা রুহুল আমিন।
কথা বলা তো দূরের কথা, দম ফেলারও জো নেই রুহুল আমিনেরও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমির ফসল কাটতেই সময় যাচ্ছে তার।
ফসল ফলাতে গিয়ে সব টাকাই গেছে জলে। টিকে থাকা সামান্য ফসলটুকু ঘরে তুলতে তাই দুই সন্তানকে নিয়ে নিজেও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন।
দুর্যোগকালীন পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে বিশেষ ছুটি। পরিবারের দুর্দিনে তাই বসে থাকা হয়নি জিহাদ ও জিয়ারও। গৃহস্থ বাবাকে সহায়তা করতে বুক পানি মাড়িয়ে পাকা ধান তুলে আনতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই চালিয়ে যেতে হচ্ছে মাদ্রাসাপড়ুয়া এ দু’কচি মুখকে।
কলাগাছের ভেলায় ওদের ধান পরিবহনের দৃশ্য ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ কবিতাকেই প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ওদের কলাগাছের ভেলাই যেন কবিগুরুর সেই ‘সোনার তরী’।
এমন তরী টানে ভিড়িয়ে ধানের গাদা তৈরির ফাঁকে জিহাদ বলে, ‘আগাম বন্যায় আমাদের দুই কানি (একর) ফসল তলিয়ে গেছে। টিকেছে মাত্র ১৫ শতাংশ।
এ ফসল ঘরে আনতে নৌকা ভাড়া করতে গেলে প্রতিদিন ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা লাগবে। নৌকায় এতো টাকা খরচ করলে সংসার চলবে না’।
কলাগাছের ভেলাই তাই দারিদ্র্যপীড়িত মানুষজনের সম্বল।
জিহাদ ও জিয়ার মা মেহের বেগমও ভার মুখে জানালেন, ‘সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত। দু’মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদেই ওদের পানিতে থাকতে হচ্ছে’।
বলতে বলতেই বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনিও হাত চালাতে লেগে পড়লেন ধানের গাদায়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কলাগাছের ভেলাই যেন হাওরে ‘সোনার তরী’

আপডেট টাইম : ০৫:৪০:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ এপ্রিল ২০১৭

বেড়িবাঁধ মিঠামইন হাওর থেকে:
হাওরের বিস্তীর্ণ বুকে পানি আর পানি। বুকভরা জলরাশিতে ডুবো ডুবো দুই শিশু সহোদর জিহাদ ও জিয়া।
অন্তত খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে দরিদ্র কৃষক বাবার সঙ্গে ঢলের পানিতে নামতে হয়েছে ওদেরও।
পানিতে ডুবন্ত আধা পাকা ধান যে করেই হোক টেনে তুলতেই হবে। অথচ স্বপ্নভঙ্গের অধ্যায়ে শেষ সম্বলটুকু ঘরে তুলতে অপরিহার্য নৌকা ভাড়া করার সক্ষমতাও নেই।
হা হুতাশের এ সময়ে থই থই পানিতে কলাগাছের ভেলাই তাই দুই ভাইয়ের শেষ ভরসা।
নিজেদের তৈরি এ বাহনেই ভেজা ধানের আঁটি তুলে শহররক্ষা বাঁধের সড়কের টানের দিকে শরীর ভাসিয়ে দিয়েছে ওরা।
পানিতে স্বামীর বোনা স্বপ্ন তলিয়ে যাওয়ার পর নিজ সন্তানদের সংগ্রামে নামার দৃশ্য অসহায় দৃষ্টিতে টানে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মা মেহের বেগমও। সন্তানদের মতোই এ ধান যে তারও জীবন-মরণ।
মিঠামইন উপজেলা সদরের শহররক্ষা বাঁধের পাদসীমায় পাকা সড়ক। সড়কের কোণাঘেঁষে সারি সারি পাকা-আধা পাকা ধানের গাদা। সপ্তাহ দুয়েক আগেও যার সামনে ছিলো সোনা রাঙা ধানের মাঠ।
চৈত্রের অকাল বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে কৃষকের মুঠো মুঠো স্বপ্ন। ফসল হারানোর হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে মোড়া তাই এ বেড়িবাঁধ লাগোয়া গ্রামগুলো। বছরের একমাত্র ফসল বিলীন হওয়ায় অসহায় মানুষজনের মাথায় ভেঙে পড়েছে নীলাকাশ।
বুক সমান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা ধানের থোড়া কেটে আনতে পদে পদে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
ফসল কাটতে ভোরবেলাতেই ভিজে টইটুম্বর ভাগ্যবিড়ম্বিত কৃষকদের জীবন সংগ্রামের চিত্রকল্পেরই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে বেড়িবাঁধও।
তাদের মতোই হাওরের ভয়ঙ্কর থাবায় জিহাদ ও জিয়ার ভাগ্যাকাশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। প্রায় দুই একর ফসল হারিয়েছেন ওদের বাবা রুহুল আমিন।
কথা বলা তো দূরের কথা, দম ফেলারও জো নেই রুহুল আমিনেরও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমির ফসল কাটতেই সময় যাচ্ছে তার।
ফসল ফলাতে গিয়ে সব টাকাই গেছে জলে। টিকে থাকা সামান্য ফসলটুকু ঘরে তুলতে তাই দুই সন্তানকে নিয়ে নিজেও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন।
দুর্যোগকালীন পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে বিশেষ ছুটি। পরিবারের দুর্দিনে তাই বসে থাকা হয়নি জিহাদ ও জিয়ারও। গৃহস্থ বাবাকে সহায়তা করতে বুক পানি মাড়িয়ে পাকা ধান তুলে আনতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই চালিয়ে যেতে হচ্ছে মাদ্রাসাপড়ুয়া এ দু’কচি মুখকে।
কলাগাছের ভেলায় ওদের ধান পরিবহনের দৃশ্য ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ কবিতাকেই প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ওদের কলাগাছের ভেলাই যেন কবিগুরুর সেই ‘সোনার তরী’।
এমন তরী টানে ভিড়িয়ে ধানের গাদা তৈরির ফাঁকে জিহাদ বলে, ‘আগাম বন্যায় আমাদের দুই কানি (একর) ফসল তলিয়ে গেছে। টিকেছে মাত্র ১৫ শতাংশ।
এ ফসল ঘরে আনতে নৌকা ভাড়া করতে গেলে প্রতিদিন ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা লাগবে। নৌকায় এতো টাকা খরচ করলে সংসার চলবে না’।
কলাগাছের ভেলাই তাই দারিদ্র্যপীড়িত মানুষজনের সম্বল।
জিহাদ ও জিয়ার মা মেহের বেগমও ভার মুখে জানালেন, ‘সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত। দু’মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদেই ওদের পানিতে থাকতে হচ্ছে’।
বলতে বলতেই বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনিও হাত চালাতে লেগে পড়লেন ধানের গাদায়।