ঢাকা ১২:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পত্রের টানে বাঁধন হারা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫১:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০১৭
  • ৩৯২ বার

বেশি নয়, এইতো মাত্র দেড় দশক আগেও ‘পত্রমিতালী’ বলে একটি বিষয় ছিল। পত্রিকা ও বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে পত্র বিনিময়ের চর্চা হতো। কখনও কখনও তার মাঝ থেকে দু-একজনের সঙ্গে গড়ে উঠত নিখাঁদ বন্ধুত্ব।

আমরাই বোধহয় সেই চর্চার সর্বশেষ প্রজন্ম। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব চলে এলো হাতের মুঠোয়, হারিয়ে গেল মধুর পত্র আদান-প্রদানের চর্চা।

একটি চিঠি মানে অনেক কথা, অনেক অজানা বিষয়ের সাথে পরিচিতি। একটি চিঠি কেবল একটি চিঠিই ছিল না, বরং একেকটি তরতাজা গল্প। প্রগতি মেনে না নেওয়া মুর্খতা। সেই প্রগতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কথা সুন্দর, সাবলীল ও বাস্তবসম্মত পথ ধরে। কিন্তু আমাদের এখানে সমাজ মানসের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি ঘটার অনেকটা আগেই তা এসে গেল। এ যেন অবুঝ শিশুর হাতে গরম লৌহ দণ্ড সপে দেওয়ার মতো। আর তাই বোধহয় আমরা এখন অনেকটাই নিরস ও সারমর্মহীন। সবকিছুতেই কেমন যেন কৃত্রিমতার ভয়ানক আবরণ।

যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে বরং প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। যতটুকু মনে পড়ে, তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ছি, পৃথিবীটাকে নতুন করে, নিজের মতো করে ভাবতে শিখছি, নিজ গণ্ডির ডালপালা ছড়াচ্ছে চৌকাঠ পেরিয়ে অনেক দূর। ঠিক এই সময়টিতে সদা প্রসারমান গণ্ডির মাঝে এসে ধরা দেয় পত্রমিতালীর ঝোঁক। প্রথমে চিঠি, তারপর জন্মদিন, নববর্ষ ও অন্যান্য দিবসের শুভেচ্ছা অথবা ঈদকার্ড আদান-প্রদান।

এভাবেই অসম বয়সী দুজন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। শরৎচন্দ্র তো তার অসাধারণ সৃষ্টি ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে ইন্দ্রনাথ আর শ্রীকান্তের অসম বয়সের বন্ধুত্বকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেই গেছেন-‘বন্ধুত্বের জন্য বয়স নয়, মানসিকতা মুখ্য’। আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটল। আর সেটানে ছুটে যাই সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এক পাড়া গাঁয়ে- হাটপাঙ্গাসি ইউনিয়নের সবুজ শ্যামল জনকিগাতী।

কোনো ঋতু ছিল মনে নেই, তবে সকালটায় হালকা শীত অনুভূত হতো। শহরে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, জন্মদিনের দাওয়াত। দাওয়াতে গিয়ে দুইদিন থাকতে হবে। এমন ছলচাতুরি করে হালকা শীতের ভোর বেলায় বাড়ি থেকে বের হই সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে। শহরের সাতমাথা নামক জায়গা থেকে আঠাশ টাকা ভাড়ায় উঠে পড়ি বাসে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস গন্তেব্যে পৌঁছে গেল। বাসস্ট্যান্ডের দোকানগুলিতে জিজ্ঞেস করে পথ জেনে নেওয়ার চেষ্টায় সফল হয়ে একটি রিকশা ঠিক করি। গন্তব্য ফেরিঘাট নামক জায়গা হয়ে খেয়াঘাট। অর্থাৎ উল্টো পথে পেছনের দিকে, যা আসার পথেই ফেলে এসেছি। কড়ই গাছের ছায়া ঢাকা ফাঁকা পথ ধরে ২৬ টাকা ভাড়ার রিকশা ছুটল দুরন্ত গতিতে। নদীর ওপর বেশ বড় একটি সেতু। একসময় যানবাহন পারাপারে ফেরি ছিল একমাত্র ভরসা। তাই জায়গাটি আজও ফেরিঘাট বলে পরিচিত। সেতু পার হয়ে রিকশা নেমে গেল পার্শ রাস্তায়। নদীর কাছাকাছি দূরত্ব দিয়ে উজানে সমান্তরাল এগিয়ে চলছে মেঠোপথ। পথের সবটুকুই কাশবনের মাঝ দিয়ে। দুপাশ থেকে লম্বা লম্বা কাশবনের ডগায় যেন পথের ওপর সবুজ আচ্ছাদন। মনের মধ্যে এবার কিছুটা ভয় অনুভূত হল। বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের অন্যতম কির্তী ’পালামৌ’ লিখতে গিয়ে সঞ্জীব চট্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ঘটনার সময় লিখলে বর্ণনা তখনকার মত হওয়াটাই স্বাভাবিক হতো, যেহেতু অনেক পরে লেখা সেহেতু, তা আর হবার সম্ভাবনা নেই। আমার ক্ষেত্রেও উক্ত কথাটির ব্যতিক্রম হবার কথা নয় কারণ বেলায় বেলায় গড়িয়ে গেছে অনেক দিন, মাস এবং বছর! সবুজে ঢাকা নিরব পথে রিকশার চাকা সামান্য উঁচু-নিচুতে পড়ে যে শব্দের উৎপাদন হচ্ছে তাতেই যেন টের পেয়ে ছেলে ধরার দল সামনে এসে এই দাঁড়িয়ে পড়ল! দ্বিতীয় ভয়টি হল, কখন জানি রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে বলে, যা কিছু আছে দিয়ে দে নয়তো শেষ করে দেব! কাশবনের পথ ফুরাল, দেখা দিল নদী। নদীর নাম কি তা মনে পড়ছে না।

ঘাটে নৌকা বাঁধা, একজন দুজন করে যাত্রী উঠছে। রিকশা থামিয়ে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাওয়ালা বললেন, যান ওই নৌকায় উঠেন। ঘেমে জুবুথুবু হয়ে যাওয়া রিকশাওয়ালার পরিশ্রান্ত মুখ খানি দেখে অনেক মায়া হল। অথচ, খানিক আগেই কি সব ভাবছিলাম!

বিশ-পঁচিশ জন যাত্রী নিয়ে মাঝি পাল তুলে নৌকা ছেড়ে দিল। আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যাই ওপারে। নৌকার যাত্রীদের মাঝ থেকেই পেয়ে যাই তিনজন সহযাত্রী। তারাও একই পথের পথিক তবে অর্ধেকটা পথ পর্যন্ত। বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হত দরিদ্র মানুষগুলি এখনও বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের জেলায় করতে আসে। আমার আপাদত তিন সহযাত্রী তেমনই মানুষ, যারা কাজ করতে চলে এসেছেন সিরাজগঞ্জে। ত্রিশ মিনিট হাঁটার পর বুঝলাম তারা না থাকলে জনমানবহীন এই গ্রামীণ পাথারের মাঝ দিয়ে আমাকে একাই চলতে হত। বয়সে তাদের অনেক ছোট হলেও আপনি বলে সম্বোধন করে যাচ্ছে, সে সঙ্গে অনেক সম্মান। আপনি বলতে বারণ করায় বলে, আপনি ভদ্র মানুষ তুমি বা অন্য কিছু কেমনে বলি? চলছে পায়ে হাঁটা, প্রত্যন্ত গ্রাম, কাখনওবা দু-এক মাইলের মধ্যে কোনো বসতি নেই। কেবল ফসল ভরা ক্ষেত আর ক্ষেত! পথিমধ্যে পড়ে পাই পাঁচ টাকার নোটের মাঝে শত মুড়ি দেওয়া এক দুই টাকার কয়েকটি নোট। পাঁচশ টাকার নোট পড়ে পেলে কায়দা করে তা পকেটে পুরে রাখি অথচ, টাকার পরিমাণ পাঁচ/দশ হলে আশপাশে ফকির-ফাকার বা দান বাক্স খুঁজি। আমিও বোধহয় তেমনটাই ভেবে টাকা কয়টা সহযাত্রীদের দিতে চাইলাম, নিতে অসম্মতি জানালে পরিস্থিতি সামাল দেই সম্মুখের দোকানটা পেয়ে। চার জনের জন্য একটি করে পাউরুটি কেনার পরও দুই তিন টাকা রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যা দিয়ে তাদেরকে বিড়ি কিনে দিতে সক্ষম হই। কথায় কথায় যখন তাদের পথ শেষ তাখন আমার কেবল অর্ধেকটা, যেতে হবে অনেক দূর! কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এতটাই আপন হয়ে যাই যে, বিদায় বেলায় ক্ষণিকের আবেগে চোখ দুটো ছলো ছলো হয়ে এলো।

বাকি পথ কেবলই একার, কেউ নেই। সরু পথের দুই ধারে সবুজ ক্ষেত, আইল ধরে চড়ছে গরু তারপর ছায়া ঢাকা বসতি, কিছুই ভালো লাগছে না! মনের মধ্যে বারংবার ভেসে আসছে ক্ষণেক আগে বিদায় দেওয়া সহযাত্রীদের কথা। মুরুব্বী গোছের কয়েকজন লোক স্নেহে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন, কোথা থোকে এসেছি এবং কোথায় যাব। গন্তব্যের নাম জেনে পরামর্শ দেন, হাটপাঙ্গাসি ইউনিয়ন বাজারে না গিয়ে বিকল্প পথে ঠিকানায় পৌঁছে যেতে। বিকেল নাগাদ উপস্থিত হয়ে অবাক করে দেই কলম বন্ধুকে। গ্রামটি সম্পর্কে এতটাই জেনেছিলাম যে, আগে থেকেই তার জান ছিল ঠিকই কোনো একদিন গিয়ে হাজির হব। সত্যি সত্যিই কাণ্ডটা যে ঘটিয়ে দেব তা তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। আশপাশের দু’চার বাড়ি থেকে লোক জড়ো হল আগুন্তুককে একটি বার দেখার জন্য। কেউ কেউ তো কত মাইল পথ হেঁটে এলাম সে হিসেব কষতে তখনই বেতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অবাক করে দিতে যাওয়া তাই সচরচর যাতায়াতের পথটা বাতলে না নিয়ে চিঠির খামে লেখা ঠিকানা ধরে ধরে যাওয়া।

পথ যে অনেক বেশি পাড়ি দিয়ে ফেলেছি তা বুঝতে পাই তাদের উৎসাহ দেখে। ৪০/৫০ বছর বয়সী দুই একজনের অভিমত, জেলা সদর যেতে এই পথের ব্যবহার জীবনে তারা একবারও করেনি। ভ্রমণের মজাটা বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে গেল, হলে অবশ্য মন্দ হত না কিন্তু তা যে পারছি না! কারণ, জানকিগাতী আর হাটপাঙ্গাসির অভিজ্ঞতা থেকে দুচার কথা না বললেই নয়।

রাতের খাবারের কথা মনে পড়লে চোখের সামনে এখনও ভেসে ওঠে এক থালি ইলিশ বিরিয়ানির কথা। সাদা ধবধবে পোলাওয়ের মাঝে ইলিশ মাছের চাকা, পাশে ছড়ানো দুই একটা কাচা মরিচ। চুলা থেকে নামিয়ে এক্ষণই বেড়ে দেওয়া হয়েছে। মন মাতানো সুগন্ধের বাস্পীয় ধোঁয়া উড়ছে। পরের দিন এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর পর্ব। তাদের আতিথিয়েতায় মনে হল কোনো নির্দিষ্ট বাড়ির নয় সারাটা পাড়ারই অতিথি অমি। দুপুর হলেই সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম দেড়-দুই মাইল ফাঁকে ইছামতি নদীতে সাঁতার দেবার জন্য। সাইকেল চললো ভনভন গতিতে, পেছনের ক্যারিয়ারে শক্ত করে বসে আছি। আগে পিছে আরো দুইটি সাইলে, তাতেও দুজন করে বসা। ফেরার পথে পুরনো বট-পাকুর বৃক্ষের ছায়ার তলে পরিত্যক্ত হাটখোলার মাঝ দিয়ে রাস্তা। পাশাপাশি দুটি সুবৃহৎ বট বৃক্ষ ঘিরে বহু মানষের ভিড়। নিকটে গিয়ে জানা গেল স্থানিয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গাছ দুটিকে বিবাহবন্ধনে জড়িয়ে দিচ্ছে। বট বৃক্ষের বিবাহ অনুষ্ঠান উপভোগ পরবর্তী লাড্ডু-বাতাশা খাওয়ার পর বাড়ি ফিরে এবার হাটপঙ্গাসি দেখতে যাওয়া। গ্রামীণ হাট, মানুষে গিজগিজ করছে। কি নেই সে হাটে, খাদ্য দ্রব্য ও তৈজসপত্র সব কিছুতে একেবারে টৈটুম্বুর।

হাট থেকে ফেরার পুথে জানকিগাতীর শুরুতেই একটি দিঘী। দিঘীর চার ধার দিয়ে নানা জাতের বৃক্ষ। পুরনো দিঘী নিয়ে রয়েছে এক চমকপ্রদ লোক কাহিনি-অতীতে এলাকার মানুষ পুত্র-কন্যার বিবাহের অনুষ্ঠান পাড়ি দেওয়ার জন্য হাড়ি-পাতিল ও থালা বাসনের প্রয়োজনে দিঘীর স্মরণাপন্ন হত। কোমর পানিতে নেমে হাত জোর করে প্রার্থনা করলে সমস্ত কিছু ভেসে উঠত। অনুষ্ঠান শেষে তা পুনরায় দিঘীর জলে ফেরৎ দিতে হত। কোনো একদিন এক গৃহস্থ কন্যার বিবাহে সাহায্য পেল বটে কিন্তু ফেরৎ দেবার সময় লোভকে সংবরণ করতে না পেরে একটু ব্যতিক্রম করে ফেলল। তারপর থেকে না কি দিঘী আর কারও প্রার্থনায় সাড়া দেয় না।

দেখতে দেখতে কলম বন্ধুর বাড়ি বেড়ানোর সময় ফুরিয়ে এলো। তৃতীয় দিন সকালে আবার সেই সাইকেলে চেপে রওনা। মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানির জন্মস্থান ধানগড়ার পর খরস্রোতা ধানগড়া নদী। সময় স্বল্পতার কারণে মজলুম জননেতার স্মৃতি বিজড়িত কিছুই দেখা হল না তবে এতটুকুই শান্ত্বনা যে, তার শৈশবমাখা দিনগুলি যে মাটিতে, যে বাতাসে একাকার তারই স্পর্শ নিতে নিতে ধানগড়া নদীর পাড়ে পৌঁছে যাই। জোড়া নৌকায় (পাশাপাশি দুটি নৌকা বাঁধা) করে পারাপার হচ্ছে ধানের বস্তা, রিকশা-ভ্যান, সাইকেল এবং অজস্র মানুষ। যাত্রী হয়ে আমরাও উঠে পড়লাম। সবশেষে বগুড়ার উদ্দেশ্যে বাসের জন্য আরও এক ঘণ্টার সাইকেল জার্নি। চান্দাইকোনা বাজার এসে বিদায় বলে উঠে পড়ি বাড়ি ফেরার বাসে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

পত্রের টানে বাঁধন হারা

আপডেট টাইম : ১১:৫১:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০১৭

বেশি নয়, এইতো মাত্র দেড় দশক আগেও ‘পত্রমিতালী’ বলে একটি বিষয় ছিল। পত্রিকা ও বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে পত্র বিনিময়ের চর্চা হতো। কখনও কখনও তার মাঝ থেকে দু-একজনের সঙ্গে গড়ে উঠত নিখাঁদ বন্ধুত্ব।

আমরাই বোধহয় সেই চর্চার সর্বশেষ প্রজন্ম। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব চলে এলো হাতের মুঠোয়, হারিয়ে গেল মধুর পত্র আদান-প্রদানের চর্চা।

একটি চিঠি মানে অনেক কথা, অনেক অজানা বিষয়ের সাথে পরিচিতি। একটি চিঠি কেবল একটি চিঠিই ছিল না, বরং একেকটি তরতাজা গল্প। প্রগতি মেনে না নেওয়া মুর্খতা। সেই প্রগতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কথা সুন্দর, সাবলীল ও বাস্তবসম্মত পথ ধরে। কিন্তু আমাদের এখানে সমাজ মানসের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি ঘটার অনেকটা আগেই তা এসে গেল। এ যেন অবুঝ শিশুর হাতে গরম লৌহ দণ্ড সপে দেওয়ার মতো। আর তাই বোধহয় আমরা এখন অনেকটাই নিরস ও সারমর্মহীন। সবকিছুতেই কেমন যেন কৃত্রিমতার ভয়ানক আবরণ।

যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে বরং প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। যতটুকু মনে পড়ে, তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ছি, পৃথিবীটাকে নতুন করে, নিজের মতো করে ভাবতে শিখছি, নিজ গণ্ডির ডালপালা ছড়াচ্ছে চৌকাঠ পেরিয়ে অনেক দূর। ঠিক এই সময়টিতে সদা প্রসারমান গণ্ডির মাঝে এসে ধরা দেয় পত্রমিতালীর ঝোঁক। প্রথমে চিঠি, তারপর জন্মদিন, নববর্ষ ও অন্যান্য দিবসের শুভেচ্ছা অথবা ঈদকার্ড আদান-প্রদান।

এভাবেই অসম বয়সী দুজন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। শরৎচন্দ্র তো তার অসাধারণ সৃষ্টি ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে ইন্দ্রনাথ আর শ্রীকান্তের অসম বয়সের বন্ধুত্বকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেই গেছেন-‘বন্ধুত্বের জন্য বয়স নয়, মানসিকতা মুখ্য’। আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটল। আর সেটানে ছুটে যাই সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এক পাড়া গাঁয়ে- হাটপাঙ্গাসি ইউনিয়নের সবুজ শ্যামল জনকিগাতী।

কোনো ঋতু ছিল মনে নেই, তবে সকালটায় হালকা শীত অনুভূত হতো। শহরে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, জন্মদিনের দাওয়াত। দাওয়াতে গিয়ে দুইদিন থাকতে হবে। এমন ছলচাতুরি করে হালকা শীতের ভোর বেলায় বাড়ি থেকে বের হই সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে। শহরের সাতমাথা নামক জায়গা থেকে আঠাশ টাকা ভাড়ায় উঠে পড়ি বাসে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস গন্তেব্যে পৌঁছে গেল। বাসস্ট্যান্ডের দোকানগুলিতে জিজ্ঞেস করে পথ জেনে নেওয়ার চেষ্টায় সফল হয়ে একটি রিকশা ঠিক করি। গন্তব্য ফেরিঘাট নামক জায়গা হয়ে খেয়াঘাট। অর্থাৎ উল্টো পথে পেছনের দিকে, যা আসার পথেই ফেলে এসেছি। কড়ই গাছের ছায়া ঢাকা ফাঁকা পথ ধরে ২৬ টাকা ভাড়ার রিকশা ছুটল দুরন্ত গতিতে। নদীর ওপর বেশ বড় একটি সেতু। একসময় যানবাহন পারাপারে ফেরি ছিল একমাত্র ভরসা। তাই জায়গাটি আজও ফেরিঘাট বলে পরিচিত। সেতু পার হয়ে রিকশা নেমে গেল পার্শ রাস্তায়। নদীর কাছাকাছি দূরত্ব দিয়ে উজানে সমান্তরাল এগিয়ে চলছে মেঠোপথ। পথের সবটুকুই কাশবনের মাঝ দিয়ে। দুপাশ থেকে লম্বা লম্বা কাশবনের ডগায় যেন পথের ওপর সবুজ আচ্ছাদন। মনের মধ্যে এবার কিছুটা ভয় অনুভূত হল। বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের অন্যতম কির্তী ’পালামৌ’ লিখতে গিয়ে সঞ্জীব চট্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ঘটনার সময় লিখলে বর্ণনা তখনকার মত হওয়াটাই স্বাভাবিক হতো, যেহেতু অনেক পরে লেখা সেহেতু, তা আর হবার সম্ভাবনা নেই। আমার ক্ষেত্রেও উক্ত কথাটির ব্যতিক্রম হবার কথা নয় কারণ বেলায় বেলায় গড়িয়ে গেছে অনেক দিন, মাস এবং বছর! সবুজে ঢাকা নিরব পথে রিকশার চাকা সামান্য উঁচু-নিচুতে পড়ে যে শব্দের উৎপাদন হচ্ছে তাতেই যেন টের পেয়ে ছেলে ধরার দল সামনে এসে এই দাঁড়িয়ে পড়ল! দ্বিতীয় ভয়টি হল, কখন জানি রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে বলে, যা কিছু আছে দিয়ে দে নয়তো শেষ করে দেব! কাশবনের পথ ফুরাল, দেখা দিল নদী। নদীর নাম কি তা মনে পড়ছে না।

ঘাটে নৌকা বাঁধা, একজন দুজন করে যাত্রী উঠছে। রিকশা থামিয়ে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাওয়ালা বললেন, যান ওই নৌকায় উঠেন। ঘেমে জুবুথুবু হয়ে যাওয়া রিকশাওয়ালার পরিশ্রান্ত মুখ খানি দেখে অনেক মায়া হল। অথচ, খানিক আগেই কি সব ভাবছিলাম!

বিশ-পঁচিশ জন যাত্রী নিয়ে মাঝি পাল তুলে নৌকা ছেড়ে দিল। আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যাই ওপারে। নৌকার যাত্রীদের মাঝ থেকেই পেয়ে যাই তিনজন সহযাত্রী। তারাও একই পথের পথিক তবে অর্ধেকটা পথ পর্যন্ত। বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হত দরিদ্র মানুষগুলি এখনও বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের জেলায় করতে আসে। আমার আপাদত তিন সহযাত্রী তেমনই মানুষ, যারা কাজ করতে চলে এসেছেন সিরাজগঞ্জে। ত্রিশ মিনিট হাঁটার পর বুঝলাম তারা না থাকলে জনমানবহীন এই গ্রামীণ পাথারের মাঝ দিয়ে আমাকে একাই চলতে হত। বয়সে তাদের অনেক ছোট হলেও আপনি বলে সম্বোধন করে যাচ্ছে, সে সঙ্গে অনেক সম্মান। আপনি বলতে বারণ করায় বলে, আপনি ভদ্র মানুষ তুমি বা অন্য কিছু কেমনে বলি? চলছে পায়ে হাঁটা, প্রত্যন্ত গ্রাম, কাখনওবা দু-এক মাইলের মধ্যে কোনো বসতি নেই। কেবল ফসল ভরা ক্ষেত আর ক্ষেত! পথিমধ্যে পড়ে পাই পাঁচ টাকার নোটের মাঝে শত মুড়ি দেওয়া এক দুই টাকার কয়েকটি নোট। পাঁচশ টাকার নোট পড়ে পেলে কায়দা করে তা পকেটে পুরে রাখি অথচ, টাকার পরিমাণ পাঁচ/দশ হলে আশপাশে ফকির-ফাকার বা দান বাক্স খুঁজি। আমিও বোধহয় তেমনটাই ভেবে টাকা কয়টা সহযাত্রীদের দিতে চাইলাম, নিতে অসম্মতি জানালে পরিস্থিতি সামাল দেই সম্মুখের দোকানটা পেয়ে। চার জনের জন্য একটি করে পাউরুটি কেনার পরও দুই তিন টাকা রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যা দিয়ে তাদেরকে বিড়ি কিনে দিতে সক্ষম হই। কথায় কথায় যখন তাদের পথ শেষ তাখন আমার কেবল অর্ধেকটা, যেতে হবে অনেক দূর! কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এতটাই আপন হয়ে যাই যে, বিদায় বেলায় ক্ষণিকের আবেগে চোখ দুটো ছলো ছলো হয়ে এলো।

বাকি পথ কেবলই একার, কেউ নেই। সরু পথের দুই ধারে সবুজ ক্ষেত, আইল ধরে চড়ছে গরু তারপর ছায়া ঢাকা বসতি, কিছুই ভালো লাগছে না! মনের মধ্যে বারংবার ভেসে আসছে ক্ষণেক আগে বিদায় দেওয়া সহযাত্রীদের কথা। মুরুব্বী গোছের কয়েকজন লোক স্নেহে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন, কোথা থোকে এসেছি এবং কোথায় যাব। গন্তব্যের নাম জেনে পরামর্শ দেন, হাটপাঙ্গাসি ইউনিয়ন বাজারে না গিয়ে বিকল্প পথে ঠিকানায় পৌঁছে যেতে। বিকেল নাগাদ উপস্থিত হয়ে অবাক করে দেই কলম বন্ধুকে। গ্রামটি সম্পর্কে এতটাই জেনেছিলাম যে, আগে থেকেই তার জান ছিল ঠিকই কোনো একদিন গিয়ে হাজির হব। সত্যি সত্যিই কাণ্ডটা যে ঘটিয়ে দেব তা তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। আশপাশের দু’চার বাড়ি থেকে লোক জড়ো হল আগুন্তুককে একটি বার দেখার জন্য। কেউ কেউ তো কত মাইল পথ হেঁটে এলাম সে হিসেব কষতে তখনই বেতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অবাক করে দিতে যাওয়া তাই সচরচর যাতায়াতের পথটা বাতলে না নিয়ে চিঠির খামে লেখা ঠিকানা ধরে ধরে যাওয়া।

পথ যে অনেক বেশি পাড়ি দিয়ে ফেলেছি তা বুঝতে পাই তাদের উৎসাহ দেখে। ৪০/৫০ বছর বয়সী দুই একজনের অভিমত, জেলা সদর যেতে এই পথের ব্যবহার জীবনে তারা একবারও করেনি। ভ্রমণের মজাটা বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে গেল, হলে অবশ্য মন্দ হত না কিন্তু তা যে পারছি না! কারণ, জানকিগাতী আর হাটপাঙ্গাসির অভিজ্ঞতা থেকে দুচার কথা না বললেই নয়।

রাতের খাবারের কথা মনে পড়লে চোখের সামনে এখনও ভেসে ওঠে এক থালি ইলিশ বিরিয়ানির কথা। সাদা ধবধবে পোলাওয়ের মাঝে ইলিশ মাছের চাকা, পাশে ছড়ানো দুই একটা কাচা মরিচ। চুলা থেকে নামিয়ে এক্ষণই বেড়ে দেওয়া হয়েছে। মন মাতানো সুগন্ধের বাস্পীয় ধোঁয়া উড়ছে। পরের দিন এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর পর্ব। তাদের আতিথিয়েতায় মনে হল কোনো নির্দিষ্ট বাড়ির নয় সারাটা পাড়ারই অতিথি অমি। দুপুর হলেই সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম দেড়-দুই মাইল ফাঁকে ইছামতি নদীতে সাঁতার দেবার জন্য। সাইকেল চললো ভনভন গতিতে, পেছনের ক্যারিয়ারে শক্ত করে বসে আছি। আগে পিছে আরো দুইটি সাইলে, তাতেও দুজন করে বসা। ফেরার পথে পুরনো বট-পাকুর বৃক্ষের ছায়ার তলে পরিত্যক্ত হাটখোলার মাঝ দিয়ে রাস্তা। পাশাপাশি দুটি সুবৃহৎ বট বৃক্ষ ঘিরে বহু মানষের ভিড়। নিকটে গিয়ে জানা গেল স্থানিয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গাছ দুটিকে বিবাহবন্ধনে জড়িয়ে দিচ্ছে। বট বৃক্ষের বিবাহ অনুষ্ঠান উপভোগ পরবর্তী লাড্ডু-বাতাশা খাওয়ার পর বাড়ি ফিরে এবার হাটপঙ্গাসি দেখতে যাওয়া। গ্রামীণ হাট, মানুষে গিজগিজ করছে। কি নেই সে হাটে, খাদ্য দ্রব্য ও তৈজসপত্র সব কিছুতে একেবারে টৈটুম্বুর।

হাট থেকে ফেরার পুথে জানকিগাতীর শুরুতেই একটি দিঘী। দিঘীর চার ধার দিয়ে নানা জাতের বৃক্ষ। পুরনো দিঘী নিয়ে রয়েছে এক চমকপ্রদ লোক কাহিনি-অতীতে এলাকার মানুষ পুত্র-কন্যার বিবাহের অনুষ্ঠান পাড়ি দেওয়ার জন্য হাড়ি-পাতিল ও থালা বাসনের প্রয়োজনে দিঘীর স্মরণাপন্ন হত। কোমর পানিতে নেমে হাত জোর করে প্রার্থনা করলে সমস্ত কিছু ভেসে উঠত। অনুষ্ঠান শেষে তা পুনরায় দিঘীর জলে ফেরৎ দিতে হত। কোনো একদিন এক গৃহস্থ কন্যার বিবাহে সাহায্য পেল বটে কিন্তু ফেরৎ দেবার সময় লোভকে সংবরণ করতে না পেরে একটু ব্যতিক্রম করে ফেলল। তারপর থেকে না কি দিঘী আর কারও প্রার্থনায় সাড়া দেয় না।

দেখতে দেখতে কলম বন্ধুর বাড়ি বেড়ানোর সময় ফুরিয়ে এলো। তৃতীয় দিন সকালে আবার সেই সাইকেলে চেপে রওনা। মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানির জন্মস্থান ধানগড়ার পর খরস্রোতা ধানগড়া নদী। সময় স্বল্পতার কারণে মজলুম জননেতার স্মৃতি বিজড়িত কিছুই দেখা হল না তবে এতটুকুই শান্ত্বনা যে, তার শৈশবমাখা দিনগুলি যে মাটিতে, যে বাতাসে একাকার তারই স্পর্শ নিতে নিতে ধানগড়া নদীর পাড়ে পৌঁছে যাই। জোড়া নৌকায় (পাশাপাশি দুটি নৌকা বাঁধা) করে পারাপার হচ্ছে ধানের বস্তা, রিকশা-ভ্যান, সাইকেল এবং অজস্র মানুষ। যাত্রী হয়ে আমরাও উঠে পড়লাম। সবশেষে বগুড়ার উদ্দেশ্যে বাসের জন্য আরও এক ঘণ্টার সাইকেল জার্নি। চান্দাইকোনা বাজার এসে বিদায় বলে উঠে পড়ি বাড়ি ফেরার বাসে।