প্রবাসে শাহীনূরের গা শিউরে ওঠা জীবন

গা শিউরে ওঠা এক প্রবাস-জীবনের বর্ণনা। এ যেন এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার জীবনের কথা। ক্রীতদাস নয়, তার চেয়েও বীভৎস এক জীবনে আটকা পড়েছিলেন শাহীনূর বেগম। সেই অন্ধকার গহ্বর থেকে বাঁচতে জানালার কাচ ভেঙে লাফিযে পড়েও মুক্তি মেলেনি তার। হাত ভেঙে হাসপাতাল ঘূরে আবার সেই অন্ধকার গহ্বরে ঠাঁই হয় তার।

পটুয়াখালীর শাহীনুর বেগম দালালের মাধ্যমে প্রথমে পাড়ি দেন মালয়েশিয়ায়। অবৈধভাবে পাঠানোয় সেখানে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন তিনি। ১৫ দিন মানবেতর জেল খেটে বাংলাদেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে দালালের কাছে টাকা ফেরত চাইতে গেলে তারা তাকে টাকার বদলে লেবাননে পাঠিয়ে দেয়।

লেবাননে গিয়ে আরেক নিষ্ঠুরতার মুখে পড়েন শাহীনুর। তাকে বিক্রি করে দেয়া হয় এক মালিকের কাছে। সেখানে মালিকের নিষ্ঠুর আচরণে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার। সেখান থেকে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয় সিরিয়ায়। আরেক মহাদুর্যোগ নেমে আসে তার ওপর। নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠায় পড়েন শাহীনুর বেগম।

সিরিয়ায় এক মালিকের বাসায় রাখা হয় তাকে। সেখানে প্রতিদিনই তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। শাহীনূর বলেন, ‘সেই নির্যাতন থেকে বাঁচতে আমি একপর্যায়ে জানালার থাই গ্লাস ভেঙে নিচে লাফিয়ে পড়ি। এতে আমার বাম হাত ভেঙে যায়। আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।’

হাসপাতাল থেকে শাহীনূরকে আবার ওই বাসায় ফেরত নেয়া হয়। চার মাস সেখানে ছিলেন তিনি। এরপর তাকে বিক্রি করে দেয়া হয় পতিতালয়ে। সে এক অকথ্য নির্যাতনের অধ্যায়। শাহীনূরের ভাষায়, ‘একপর্যায়ে আমার পেটে পানি জমে যায়। আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি কান্নাকাটি করে আকুতি জানায় আমাকে আগের মালিকের কাছে নিয়ে যেতে।’

একদিন লুকিয়ে বাড়িতে ফোন করেন শাহীনূর। মাকে বলেন, ‘মা, আমাকে সিরিয়ায় বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আমাকে উদ্ধার করো।’

মা বলে, কীভাবে উদ্ধার করব?

আমি বলি, র‌্যাবের কাছে যাও।

মা র‌্যাবের কাছে না গিয়ে ওই দালালের কাছে যান। দালাল জানায়, মেয়েকে উদ্ধার করতে হলে তিন লাখ টাকা লাগবে। মা এত টাকা কোথায় পাবেন। এরপর মা যান র‌্যাবের কাছে। র‌্যাব অভিযোগ নেয় মায়ের কাছ থেকে।

শাহীনূর বলেন, ‘এর সাত মাস পর আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। সিরিয়ায় প্রথম ১৫ দিন কিছুই খেতে পারিনি। শুধু পানি খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। বাংলাদেশে এসে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুই দফায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। এখনো অসুস্থ।’

প্রতারিত হয়ে জীবন বিপন্ন শাহীনুর যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন মঞ্চে উপস্থিত প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ অন্য অতিথিরা বিস্ময় নিয়ে শোনেন তা।

প্রবাসজীবনের এ নিষ্ঠুরতার কাহিনি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) নেতাদের সামনে তুলে ধরেন মানব পাচারের শিকার শাহীনুর বেগম।

শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত একটি সেমিনারে নিজের অমানুষিক প্রবাস জীবনের বর্ণনা তুলে ধরে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ‘নিরাপদ অভিবাসন ও মানব পাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে বায়রা ও র‌্যাব। সেমিনারে শাহীনূরের মতো নির্যাতিত দক্ষিণ আফ্রিকা-ফেরত রবিউলও নিজের অসহনীয় প্রবাস-জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে শাহীনূর বেগমসহ প্রতারিত ও নির্যাতিত ১০ প্রবাস-ফেরত উপস্থিত ছিলেন। তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান দেয় বায়রা। তাদের হাতে অনুদানের অর্থ তুলে দেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর