ঋতুবৈচিত্রের বাংলা বার মাসকে ছয়টি ভাগে বিভাজন করা হলেও বসন্ত ও বর্ষা ঋতু বিশেষ করে বর্ষা বাংলা ভাষার কবিদের মন ও আবেগকে যেভাবে আলোড়িত করে; আর অন্য কোনো ঋতু সে’ভাবে কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পীকে আলোড়িত পারেনা। যদিও বাংলা ভাষার কবিরা সব ঋতুকে নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন তবু বর্ষার আবেদন সবার কাছে অন্যরকমের, অন্য মেজাজের। তাছাড়া গভীর উদ্বেগের সাথে বলতে গেলে বৈশ্বিক জলবায়ূ পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলার ষড়ঋতু এরই মধ্যে তিনটি ঋতুতে পরিনত হয়েছে। শীত, বসন্ত ও বর্ষা ছাড়া অন্য তিনটি ঋতু কখনই বা যায় আসে তা যেন ঠিক ঠাওর করতে পারি না। জলবাযূ পরিবর্তনের সাথে লড়াই সংগ্রাম করে আলোচ্য তিনটি ঋতুর নিজেদের অস্তিত্ব এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তারপরও সাহিত্যের লেখকদের লেখনীতে বাংলার ষড়ঋতু মূর্ত হয়ে থাকবে চিরকালই । যাক বাংলার ঋতু বৈচিত্র নিয়ে লেখা আজকের বিষয়বস্তু নয়। বাংলাভাষাভাষি কবিদের বর্ষা কিভাবে আন্দোলিত করেছে এই প্রবন্ধে তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
বর্ষা তার ঝরঝর নির্ঝরণীতে আমাদের মনকে যুগপৎ আনন্দ-বেদনা ও বিরহকাতরতায় সিক্ত করে তুলে। মানুষের মনের কথাই শুধু বলি কেন, বর্ষা প্রাণরসে জাগিয়ে তুলে আমাদের প্রকৃতিকে। সবুজে সবুজে ভরিয়ে দেয় আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশও। গ্রীষ্মের তাপদাহে মানুষের মন যখন অস্থির হয়ে ওঠে, মানুষ ব্যকুল বর্ষা বন্দনায় মত্ত হয়। যেনো ‘কখন আসবে বর্ষা কখন জুড়াবে প্রাণ’ কাব্যিক ব্যঞ্জনার মতো। তখনই কবি ব্যাকুল বিনয়ে শ্রষ্ঠার কাছে মেঘ চায়, প্রাশিান্তির বৃষ্টি চায়-‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই’। তাই বর্ষা এলে প্রতিটিক্ষণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে কবিদের লেখা ও লেখনীতে। এ জন্যেই কবি এমন করে বলতে পারেন,‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়।
কবিদের বেলাই শুধু নয়, বর্ষার আবেদন আমাদের জীবনেও নানামুখী। যে আবেদন আমাদের মধ্য যুগের বাংলা কবিতা ও সমসাময়িক কবিদের কবিতায় অনুরণিত। চন্ডিদাস, বিদ্যাপতি গবিন্দ দাস কিংবা কালিদাসের কবিতায় বর্ষা সমার্থক হয়ে ওঠে। তারা তাই বর্ষাকে কবিতার, কবিতাকে বর্ষার পরিপূরক করে তুলেছেন, তাদের কবিতার বিভিন্ন কাব্যিক ব্যঞ্জনা অনুপ্রাস ও দ্যোতনায়। বর্ষা এলেই মানুষ ভালোবাসার অজানিত এক আহ্বানের উদ্বেলিতে হয়ে ওঠে। তাই অনেকেই বর্ষাকে ভালোবাসার ঋতু হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে। কেউ কেউ আবার বলেন বর্ষা নয় বসন্তই হলো প্রেমের ঋতু। তবে এ বিতর্কে সামিল না হয়ে এ কথা নিদ্বিধায় বলা যায় বর্ষাকেই সংখ্যা গড়িষ্ঠ ভাববাদী মানুষ প্রেমের ঋতু হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। কেননা, এ ঋতুতেই প্রকৃতিতে লাস্যময়তার সাথে সাথে মানব মনেও প্রেমের জোয়ার আনে। সেই জোয়ারে ভাসতে ভাসতেই কবিরা তাদের বিভিন্ন কবিতায় প্রকাশ করে থাকেন প্রেমের বিবিধ ব্যাকুলতা। তাই বর্ষা কখনও অবিমিশ্র প্রেমের অনুঘটক, কখনো কামনা-বাসনা আকুলতার সরব ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। সে জন্যেই বর্ষা গান ও গদ্য সাহিত্যে গরজিত মেঘ হলেও কবিতায় বর্ষা ধরা দেয় পূর্ণাঙ্গ ব্যপ্তিতে, বিভিন্ন ব্যঞ্জনা ও গুঢ়ার্থে। এভাবেই কালিদাসের মেঘদূত কবিতায় রামগিরি পর্বতের ওপারে নির্বাসিত শূন্য ও একাকীত্ব জীবনে মেঘ যখন উচুগিরির উপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ে যেতো; তখন বিরহী যক্ষের মনে জাগত প্রিয়া বিরহের যাতনা। তাই তিনি বিশদ ব্যাকুলতা বর্ণনা করে মেঘকে দূত করে পাঠাতেন প্রিয়ার কাছে। এভাবেই মধ্যযুগের কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ইন্দ হিসাবে। মধ্য যুগের কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহ পর্বে প্রেমবহ্নিতে ঘৃতের ছিটার হিসাবে কল্পনা করেছেন। একই ধারায় চন্ডিদাস তাঁর প্রেম বিরহ কাতরতার কথা প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়-
এঘোর রজনী মেঘের ঘটা/কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে/দেখিয়া পরাণ ফাটে।
আর বিদ্যাপতির রচনায়ও বর্ষার বিরহ কাতরতা কম নয়Ñ
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা ভাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর।
ওপরের দুটি কবিতার নির্মাণ গঠন ও অর্থগত দিক বিবেচনায় বলা যায় বর্ষার বিচিত্র ও সার্থক ব্যবহার হয়েছে মধ্য যুগে বাংলা কবিতায়। শুধু প্রেম বিরহেই কেন কবিদের কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রকৃতির রূপ-সৌর্ন্য বর্ণনায়, কখনো শৈশব-কৈশোরের স্মৃমিয় নস্টালজিয়ায়।
আমরা যদি মাইকেল মধুসুদন দত্তের কবিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তাহলে দেখতে পাই তিনি বর্ষাকে কল্পনা করেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসাবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যার সাথে একাত্ব ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। মধুসুদন দত্তের ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা হয়েছে এভাবেই।
গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমনী রমন লয়ে/সুখে কেলি করে /দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।
এখন আমি দৃষ্টি ফেরাতে চাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার দিকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তিনিই যেনো কবিতার মাধ্যমে বর্ষাকে পূর্ণতা দিলেন। তাঁর কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। বর্ষার ঘনকালো মেঘ আকাশকে ঢেকে দিয়ে গরুগুরু গর্জনে যখন নেমে আসে বৃষ্টির অবিরাম ধারা; সে বৃষ্টির ধারা তাঁকে হাত ধরে নিয়ে যায় শৈশব-কৈশোরের স্মৃমিয় দিনগুলোতে। তাই তাঁর কবিতার শরীরে চোখ বুলালে জেগে ওঠে প্রেমের উদ্রেক। রবীন্দ্রনাথের বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ যা বর্ষার দিনে কবিমনকে সিক্ত করে অতীত রোমন্থনে। তাই বুঝি বৃষ্টি এলেই দুরন্ত শৈশব তাঁকে হাতছানী দিয়ে ডাকে, আর কবি আক্রান্ত হন নস্টালজিয়ায়; তখনই তাঁর কবিতায় ঝরে পড়ে স্মৃতিকাতরতার বৃষ্টি-
কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এলো যে কোথা
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো কবেকার সে কথা।
সে দিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘনঘটা
থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিছিল কি হানা।
বর্ষা এলেই কবিকে তাড়িত করে অন্য এক আবেগ। বৃষ্টির নির্ঝরণীতে অধিক যেনো ব্যাকুল হয়ে ওঠে আবেগতাড়িত কবিমন। জীবন, জীবনের বন্ধন, জগৎ সংসারের পিছুটান তখন কবির কাছে গৌণ হয়ে ওঠে। অঝোরধারার বৃষ্টি কবির কাছে প্রেমিকার কান্না বলে হয়। তাই কবি বর্ষার নির্ঝরণীতে ধূয়ে মূছে দিতে চান যাবতীয় দুঃখ, যাতনা, বিষাদময় ক্লেদাক্ততা। এই জন্যেই হয়তো কবি তাঁর বর্ষা মঙ্গল কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন এতো কাব্যব্যঞ্জনা। বর্ষার ঘনঘটায় কবি রবীন্দ্রনাথ যুগপৎ আনন্দ বেদনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। যখন প্যারেডের তালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে এতে তিনি যেমন পুলকিত হয়েছেন তেমনি আবার মেঘের ঘনঘটা দেখে শঙ্কিতও হয়েছেন। এ কারণেই রবীন্দ্র কাব্য ভাবনায় বার বার ফিরে এসেছে বর্ষা বিভিন্ন আঙ্গিক ও সৌকর্যে। তাই হয়তো অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে বর্ষার কবি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
এইতো গেল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথা। বাংলাভাষাভাষি কবিরা প্রত্যেকেই বর্ষাকে বেশি করে আত্মস্থ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তেমনি আরো বেশি প্রয়াস চালিয়েছে আমাদের বিদ্রোহী কবি একই সাথে প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তাঁর কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিকী ব্যঞ্জনায়। বর্ষার মেঘ তাঁর বিরহ-বেদনাকে আরো বেশি উসকে দিয়েছে। যা কবির বাদল রাতের কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে-
বাদল রাতের পাখী
উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।
তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বাদল রাতের পাখিকে বন্ধু ভেবে আর বিরহের সাথে নিজের বিরহ একাকার করতে চেয়েছেন। তিনি বর্ষাকে ভেবেছেন তাঁর দুঃখ যাতনার সারথী হিসাবে। সে কারণেই হয়তো বর্ষাবিদায় কবিতায় কবিমনের যত আকুতি ঝরে পড়ে-
‘যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকে ওঠনা কবরী ওঠে না দুলি
যেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্ন তাপসিদী অচপল
তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল’।
একইভাবে পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের বর্ষার কবিতা বন্দনা বিষেয়র কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমানের বৃষ্টি বন্দনায় অনাবৃষ্টি কবিতায় লিখেছেন-
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যঘ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়,
যদি জড়ো হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল বৃষ্টি
অলস পেন্সিল হাতে বকমার্কা। পাতা জুড়ে আকাশের নীল।
তেমনিভাবে আল মাহমুদ, সৈয়দ সামসুল হক, কবি ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুন, আসাদ চৌধুরী আসলাম সানীসহ বাংলা-দেশের সমকালীন কবিদের কবিতায় বর্ষা বন্দনা ফুঠে ওঠেছে অনবদ্যভাবে। বাংলা ভাষার এমন কোনো কবিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যাকে বর্ষা ও তার ঘনকালো মেঘ মনকে আচ্ছন্ন করেনি।
কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা তাঁর বৃষ্টি পড়ে কবিতায় মাধ্যমে বর্ষার বৃষ্টিকে নানা আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন-
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে/মনে মনে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/বনে বনে বৃষ্টি পড়ে
মনের ঘরে চরের বনে/নিখিল নিঝুম গাও গেরামে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
কবি হাসান হাফিজ তার ‘বর্ষাভেজা পদাবলীতে’ বর্ষাকে আনন্দ বেদনা উভয় রূপেই কল্পনা করেছেন তিনি তাঁর কবিতায় শ্রাবণের বর্ণনা করেছেন এভাবে-
শ্রাবণে বিরহ শুধু নয়, আগুনও রয়েছে
সেই তাপে শুদ্ধ হবে অসবর্ণ মিল পিপাষা।
ঘন বর্ষার শ্রাবণের মেঘ যখন দলবেঁধে আকাশে উড়ে বেড়ায় সে মেঘের সাথেও কবি, অ-কবি সকল ভাবপ্রবণ মানুষের মনও কল্পনার জগতে উড়ে বেড়ায়। তখন মানুষের মনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনাগুলো যেনো মূর্ত হয়ে ওঠে মেঘের শরীরে। দক্ষিণের আকাশে জমাট বাঁধা কালো মেঘ যখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে, তখন মনে হয় বৃষ্টি বুঝি তার কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে। তাই সে তখন তার জীবনের সকল কষ্ট ও মনস্তাপকে বৃষ্টির সাথে একাকার করে ফেলে। সেই মুহূর্তে বর্ষার বৃষ্টিকে বড়বেশি সমব্যথি মনে হয় একজন বিরহকাতর মানুষের কাছে, সে কবি হোক; বা না ই হোক।