তিনদিনের টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। বান্দরবান-কেরানিহাট সড়কে পানি উঠায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, উখিয়া ও টেকনাফের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। খাগড়াছড়ির চেঙ্গী ও মাইনী নদীতে পানি বাড়ছে। পৌর এলাকার ৬ গ্রামের ৫০০ পরিবার পানিবন্দি। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধির পাঠানো খবর:
বান্দরবান : জেলার বিভিন্ন স্থানে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। উজানে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে শঙ্খ ও মাতামুহুরী নদীতে পানিপ্রবাহ বেড়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে বিপদসীমার কাছাকাছি পানি প্রবাহিত হয়।
বান্দরবান মৃত্তিকা সংরক্ষণ কেন্দ্র জানায়, সোমবার সকাল ১১টা থেকে বুধবার সকাল ১১টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় ৩০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দিন ১৭০ মিলিমিটার এবং গতকাল ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে বান্দরবান-কেরানিহাট সড়কের মাহালিয়া পয়েন্ট ২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বুধবার সকাল থেকে বান্দরবানের সাথে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ সারাদেশের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবল বর্ষণের কারণে বুধবার ভোররাতে পৌর এলাকার লাঙ্গিপাড়ায় পাহাড় ধসে পড়েছে। এতে কেউ হতাহত না হলেও পাহাড়ের মাটি এসে সড়কের উপর পড়ায় ওপাশের লোকজন আটকা পড়েছে।
টানা বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে বিপজ্জনক এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। দিনভর মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। বান্দরবান পৌর এলাকার আর্মিপাড়ার কয়েকটি এলাকা ২ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়। এ সময় বিভিন্ন গলিপথ ও সংযোগ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ৬০০ পরিবার আটকা পড়ে। রাত ১২টার দিকে বৃষ্টিপাত থেমে গেলে পানি নেমে যায়।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, লামা উপজেলার ফাইতং, সরই, চিওরতলী, গজালিয়া ও রুমা উপজেলার কয়েকটি নিম্নাঞ্চল জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী জানান, দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনকেও সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার : জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। মঙ্গলবার থেকে হালকা বর্ষণ হলেও গতকাল বুধবার সকালে ভারি বর্ষণ শুরু হয়। এছাড়া পাহাড়ি এলাকার পানি নেমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
শহরের বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, টেকনাইফ্যা পাহাড়, পাহাড়তলী, লাইট হাউজ পাড়াসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অব্যাহত পাহাড় কাটার কারণে সামান্য বর্ষণেই পাহাড়ি মাটি গড়িয়ে নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে পড়ে। ফলে শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
বুধবার সকাল থেকে টানা ভারি বর্ষণে শহরের বৌদ্ধমন্দির সড়ক, বাজারঘাটা, বড়বাজার ও মাছবাজার এলাকা জলাবদ্ধতাসহ কাদামাটিতে ভরে যায়। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র সরোয়ার কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, উখিয়া ও টেকনাফের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অভ্যন্তরীণ অনেক সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কক্সবাজার জেলা আবহাওয়া অফিস বুধবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় ১৬৫ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।
চকরিয়ায় ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী নদীর পানি চিরিঙ্গা ব্রিজ লোকায় বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীর দুই তীরে বসবাসকারী হাজারো পরিবারের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম উৎকণ্ঠা। বন্যার মতো পরিস্থিতি না হলেও মাতামুহুরী নদীবিধৌত ইউনিয়ন ও পৌরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে । ভারি বর্ষণ আরো দুই-একদিন স্থায়ী হলে এবারও ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে চকরিয়ায়।
চকরিয়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র শহীদুল ইসলাম ফোরকান কালের কণ্ঠকে জানান, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড মাতামুহুরী নদীর তীরঘেঁষা। তাই নদীতে উজান থেকে ঢলের পানি নামলেই ডোবে যায় এসব ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চল। এর মধ্যে কোচপাড়ার কয়েকশ’ বসতবাড়িতে ঢুকে পড়েছে ঢলের পানি। এছাড়া ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পৌরশহর চিরিঙ্গার বেশ কিছু এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে নদীতীরের বিপুলসংখ্যক বসতবাড়ি, সড়ক, ধর্মীয়স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পৌর বাসটার্মিনাল সংলগ্ন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।
মাতামুহুরী নদীঘেঁষা কাকারা ইউনিয়নের বাসিন্দা সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ জানান, তিনদিনের ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল হু হু করে বাড়ছে মাতামুহুরী নদীতে। ভারি বর্ষণ আরো কয়েকদিন স্থায়ী হলে এবারও ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে চকরিয়ায়। এখন (গতকাল বিকেল) মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হবে কাকারা ইউনিয়নের।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানান, ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানি মাতামুহুরী নদীতে বাড়ার সাথে সাথে তাঁর ইউনিয়নের উত্তর মানিকপুর ও দক্ষিণ সুরাজপুর গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে অন্তত হাজারো পরিবার।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া জানান, তাঁর ইউনিয়নের ডেইঙ্গাকাটা, রসুলাবাদ, হিন্দুপাড়া, বিবিরখিল, গোবিন্দপুর, দক্ষিণপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কয়েকটি গ্রামের চলাচল সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় নৌকায় করে যাতায়াত করছে মানুষ। মাতামুহুরী নদী, হারবাং ছড়া ও সোনাইছড়ি খালের পানিতে এই অবস্থা হয়েছে বলে তিনি জানান।
কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শরীফ উদ্দিন চৌধুরী জানান, মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তাঁর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের নিম্নঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর ছোট ভেওলা, কুরইল্যারকুম পয়েন্ট যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। ঢলের পানিতে ওই এলাকার কয়েকশত বসতবাড়ির মানুষ এখন পানিবন্দি রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চকরিয়া উপ-বিভাগের চিরিঙ্গা শাখা প্রকৌশলী (এস.ও) মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভারি বর্ষণের কারণে চকরিয়া উপজেলার বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে এখনো বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম জানান, ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় এবং মাতামুহুরী নদীতে ঢলের পানি আসতে শুরু করায় ইতিমধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন। তাই সম্ভাব্য ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে জান-মাল বাঁচাতে সবকটি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। সভায় দুর্যোগ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে এবং সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
খাগড়াছড়ি : টানা দুদিনের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদী ও দীঘিনালার মাইনী নদীতে পানি বাড়ছে। অতিবৃষ্টিতে চেঙ্গীর পানি উপচে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গঞ্জপাড়া, মুসলিমপাড়া, সিঙ্গিনালাসহ বেশ কয়েকটি পাড়ার শতাধিক বাড়িঘরে কোমর পানি উঠেছে। এছাড়া নিচু সব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে প্রবল বর্ষণের কারণে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের বাংলোর পেছনে পাহাড়ের একাংশ ভেঙে পড়েছে। গতকাল বুধবার সকালে আকস্মিকভাবে পাহাড়ের একটি অংশ ধসে পড়লে শহরের সাথে ইসলামপুর এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থা কয়েক ঘণ্টার জন্য ব্যাহত হয়। পরে পৌরসভার পক্ষ হতে মাটি অপসারণ করা হয়। এছাড়া সবুজবাগ, শালবান এলাকায় বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড় ধস হয়েছে। তবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল আলম জানান, এ পর্যন্ত ছয়টি গ্রামের প্রায় ৫০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।