রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ চলতি মাসের দ্বিতীয়ার্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে পারেন। নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে সামনে রেখেই রাষ্ট্রপতি এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিজয় দিবসের পরপরই সংলাপের আয়োজন করা হচ্ছে। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন রাষ্ট্রপতি।’
প্রেস সচিব কোনো তারিখ না বললেও বঙ্গভবনের একজন কর্মকর্তা জানান, ১৮ ডিসেম্বর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার কথা ভাবা হচ্ছে। আর প্রথম দিনই ডাকা হতে পারে বিএনপিকে।
চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি সিঙ্গাপুর গেছেন। আগামী ১১ ডিসেম্বর তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এর পরপরই রাষ্ট্রপতি সংলাপে বসার বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি সংলাপে বসতে যাচ্ছেন- এমন খবরে স্বাগত জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ইসি পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী মঙ্গলবার সকালে বঙ্গভবনে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে জানানো হয়েছে, তিনি (রাষ্ট্রপতি) আলোচনা শুরু করবেন। আমরা সবচেয়ে ভালো জিনিসটা আশা করব। রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগ থেকে পজিটিভ রেজাল্ট (ইতিবাচক ফল) আশা করছি। তার এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমে, সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছতে বিশ্বাস করি। সে কারণেই দেশনেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা আশা করি, রাষ্ট্রপতি যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তাতে সফল হবেন। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে তিনি (রাষ্ট্রপতি) সক্ষম হবেন।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আশা করছি তিনি সবার মতামত নিয়ে একটি দক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে সক্ষম হবেন।’
রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ইসি গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তিনি যে উদ্যোগ নেবেন সেটাকে স্বাগত জানাই। দল হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সহযোগিতা করবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। রাষ্ট্রপতি এমন উদ্যোগ নেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছর মেয়াদের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। নতুন যে ইসি দায়িত্ব নেবে, তাদের অধীনেই ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই ‘সার্চ কমিটি’র মাধ্যমে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। এবারও ‘সার্চ কমিটি’ করে রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন নিয়োগ দেবেন বলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক অনেক আগেই জানিয়েছিলেন।
সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এরই মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক হাঙ্গেরি ও মরক্কো সফর সম্পর্কে অবহিত করতে রোববার বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সংবাদ সম্মেলনেও এ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
সূত্র মতে, খুব সীমিত সময়ের মধ্যেই এ সংলাপ শেষ করা হবে। এ জন্য একদিনে একাধিক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের মতামত নেবেন রাষ্ট্রপতি। তবে সংলাপে কোন কোন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিকভাবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার কথা ভাবা হচ্ছে। প্রথমে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কথা ভাবা হলেও বিএনপি সংসদে না থাকায় বিকল্প চিন্তা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন স্থগিত থাকায় জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সংলাপে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবেন না।
সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি সব সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ওই সংলাপে দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। ওই সংলাপের পর সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
১৩ দফা প্রস্তাব বঙ্গভবনে : ইসি পুনর্গঠনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাব মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবভনে পৌঁছে দিয়েছে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এদিন বেলা এগারোটার দিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতির সহকারী সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইনুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। বিএনপির এই দুই নেতা ১৫ মিনিট বঙ্গভবনে ছিলেন।
রাষ্ট্রপতির সহকারী প্রেস সচিব মাহমুদুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপির প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সহকারী সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইনুর রহমানের কাছে তাদের মহাসচিবের সই করা চিঠি এবং প্রস্তাবের মুদ্রিত কপি হস্তান্তর করেন।
বিএনপির প্রতিনিধি দল যাওয়ার আগেই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে রুহুল কবির রিজভী অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তরের জন্য দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপস্থাপিত ১৩ দফা প্রস্তাবাবলীর মুদ্রিত কপি ও দলের মহাসচিব স্বাক্ষরিত একটি আবেদন তার সহকারী সামরিক সচিবের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তিনি সেটা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তিনি (সহকারী সামরিক সচিব) জানিয়েছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিদেশে গিয়েছেন। তিনি ১১ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসবেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে এদেশের মানুষের যে আকাক্সক্ষা- নির্বাচন কমিশন কেমন হওয়া উচিত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন কমিশন গঠনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন । দৈনিক যুগান্তর (প্রকাশ: ৭ ডিসেম্বর,২০১৬)