৩৬ জুলাই বিশ্বরেকর্ডের বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। কেউ কেউ জানতে চাইছেন ৩৬ জুলাই’য়ের ব্যাকগ্রাউন্ডটা কি? ইতিপূর্বেই আমি লিখেছি, ৭ জানুয়ারী ভুয়া নির্বাচনের পরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা থেকে জানানো হয়েছিল, জুলাইয়ের মধ্যে হাসিনা রেজিমের পতন ঘটবে তা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শামসুল আলম।
তিনি জানান, এর আগে ‘২৩ সালের শেষার্ধেও ঢাকার ইউএস এম্বেসী সোর্স জুলাই ‘২৪ এর কথাই বলেছিল। অতঃপর, ২০২৪ সালের জুলাইতে হাসিনা চায়নায় ব্যর্থ মিশন শেষে এসে স্টুডেন্টদেরকে “রাজকারের নাতি” বলে গাল দিলো ফুঁসে উঠলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল কোটা বিরোধী আন্দোলন। টার্গেট করা হলো এই জুলাইতেই ওকে ফেলা হবে। কিন্তু জুলাই মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন হাসিনার পতন ঘটলো না, তখন হঠাৎই আমার মাথায় খেললো- জুলাই মাস বাড়িয়ে দেয়ার কথা। লিখে ফেললাম-“জুলাই মাস টেনে দেয়া হলো বিজয় অবধি- আজ ৩২, কাল ৩৩ তারিখ…এভাবে বিজয়ে গিয়ে শেষ হবে মুক্তির ক্যালেন্ডার! অর্থাৎ হাসিনার পতন না হওয়া অবধি জুলাই শেষ হবে না। আন্দোলন বেগবান করার জন্য একটি নতুন বয়ান দেয়া হলো যে, দজুলাইতে আন্দোলন জুলাইয়েই তোকে ফেলব। মানি না আগস্ট ফাগস্ট।’ যেদিনই পতন সেদিনই জুলাই শেষ। পতনের ঐ তারিখটাই হলো ৩৬ জুলাই॥ অর্থাৎ হাসিনার পতন না হওয়া অবধি জুলাই শেষ হবে না। আন্দোলন বেগবান করার জন্য একটি নতুন বয়ান দেয়া হলো যে, দজুলাইতে আন্দোলন জুলাইয়েই তোকে ফেলব। মানি না আগস্ট ফাগস্ট।’
তিনি বলেন, ‘যেদিনই পতন সেদিনই জুলাই শেষ। পতনের ঐ তারিখটাই হলো ৩৬ জুলাই॥ এতে করে সংগ্রামীদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপও বাড়লো- যতই লাশ পড়ুক, আর যাই ঘটুক না কেনো, হাসিনার পতন ঘটাতেই হবে। আর সেটাই হয়েছিল, মার্চ টু ঢাকা কর্মসুচি ৬ আগস্ট থেকে ৫ আগস্টে এগিয়ে আনার ভেতর দিয়ে। ৫ আগস্টে লক্ষ লক্ষ জনতা গণভবন (আমার ভাষায় বাস্তিল দুর্গ) ঘেরাও করলে ফ্যসিস্ট হাসিনার পতন ঘটে- যা আমার ক্যালেন্ডারের হিসাবে ৩৬ জুলাই একটি ইতিহাস! সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে চলমান টানা আন্দোলনের চতুর্থ দিন ছিল ২০২৪ সালের ৪ জুলাই। এদিন থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন আরও জোরালো হতে থাকে। ২০২৪ সালের এই দিনে ৭ জুলাই (শনিবার) দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ এবং ৮ জুলাই (রোববার) ক্লাস পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল এবং প্রয়োজনে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে এ ধর্মঘটের ডাক দেন তাঁরা। ৪ জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন ঝুম বৃষ্টিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হন রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। তারা পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন। পরে আন্দোলনকারীরা সন্ধ্যায় পরবর্তী তিন দিনের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে রাস্তা ছাড়েন। এদিন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, খুলনাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে দাবি আদায়ের শপথ নেন। এদিনই সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় আপাতত বহাল রাখে আপিল বিভাগ। এর আগে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ফলে সরকারি চাকরিতে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকে। এই রায়ের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। রায় স্থগিত চেয়ে আপিলও করে রাষ্ট্রপক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। সারাদেশে ‘কোটা পুনর্বহাল করা চলবে না’ শীর্ষক ফেসবুক গ্রুপে সবাই যুক্ত হন। গ্রুপ থেকেই যাবতীয় বিষয় আপডেট দেওয়া হয়। একই নামে টেলিগ্রাম গ্রুপও খুলেন আন্দোলনকারীরা। এদিন থেকেই কর্মসূচিগুলোতে ব্যাপক সাড়া দিতে শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৪ থেকে ৫ জুলাইয়ের মধ্যে অভিন্ন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের আহ্বানের সঙ্গে একাত্মাতা প্রকাশ করেন। এটা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যাপক সাড়া ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপক প্রচার হয়। এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী। মিছিল নিয়ে তারা মাস্টারদা সূর্যসেন হল, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের গেট হয়ে ভিসি চত্বর, টিএসসির রাজু ভাস্কর্য ঘুরে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি শেষে আন্দোলনকারীরা রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে নতুন করে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এদিন কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক-সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কের উভয় লেনে যানজট তৈরি হয়। পরে দুপুর ১টার দিকে অবরোধ তুলে নেন তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করে ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট সোমবার এ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এতে সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ ছাড়েন। তাঁর বোন শেখ রেহানার সঙ্গে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগ পাননি। ওই হেলিকপ্টারটি ভারতে অবতরণ করে। এ সময় গণভবনে অসংখ্য মানুষ ঢুকে পড়ে। তারা গণভবন লুট করে। বিকেল ৪টায় আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা।