ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির শাসনব্যবস্থা বদলানো বা রেজিম চেঞ্জের সম্ভাবনা নিয়ে ফের আলাপ তুলেছেন।
“রাজনৈতিকভাবে ‘রেজিম চেঞ্জ’ এই পরিভাষা ব্যবহার করা ঠিক হয় না, কিন্তু ইরানিদের এখনকার শাসনব্যবস্থা যদি মেইক ইরান গ্রেইট অ্যাগেইন না করতে পারে, তাহলে সেখানে রেজিম চেঞ্জ কেনইবা হবে না??? এমআইজিএ!!!” রোববার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প এমনটাই বলেন।
তার পোস্টের শেষে ইংরেজি বড় অক্ষরে লেখা এমআইজিএ-কে ‘মেইক ইরান গ্রেইট অ্যাগেইন’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ ধরা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ও তার সমর্থকরা প্রায়ই তাদের স্লোগান ‘মেইক আমেরিকা গ্রেইট অ্যাগেইন’-কে সংক্ষিপ্ত করে এমএজিএ বা মাগা বলে থাকে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ট্রাম্প এমন এক সময়ে ইরানে শাসনব্যবস্থা বদলানোর প্রসঙ্গ তুললেন, যখন ইরানে হামলা নিয়ে তার ‘মাগা’ সমর্থকরা দ্বিধাবিভক্ত; তার প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তাও ইরানে শাসনব্যবস্থা বদলানোর লক্ষ্য ওয়াশিংটনের নেই বলে বারবার আশ্বস্ত করে যাচ্ছেন।
শনিবারই যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানোর ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনার উপরে থাকা পাহাড়ে আছড়ে পড়েছে। কেবল ফোরদোই নয়, যুক্তরাষ্ট্র কাছাকাছি সময়ে ইরানের নাতাঞ্জ ও ইস্ফাহান পারমাণবিক স্থাপনায়ও আঘাত হেনেছে।
তেহরান বলেছে, তারা যে কোনো মূল্যে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।
এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলাও অব্যাহত আছে। শনিবার পশ্চিম ইরানে এক বিস্ফোরণে আধা ডজন ইরানি সামরিক কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছেন বলে দেশটির একটি গণমাধ্যম স্বীকারও করেছে। তার আগে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবের একাধিক ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে, অনেক মানুষকে আহত করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের লেবানন ছাড়তে বলেছে এবং ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে থাকা কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বেশি ঘোরাফেরা না করে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে।
মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয় এক নির্দেশনায় ‘যু্ক্তরাষ্ট্রে বর্ধিত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির’ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। বড় বড় শহরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
ইরান এর আগে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘাঁটিতে হামলা বা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ২৪ ঘণ্টার বেশি পেরিয়ে গেলেও তারা এখন পর্যন্ত সে পথে হাঁটেনি।
ইস্তাম্বুলে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, তার দেশ সব বিকল্প বিবেচনা করে দেখছে। তবে পাল্টা আঘাতের আগ পর্যন্ত আলোচনায় ফেরা হবে না।
“যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়ে দিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করে না। তারা কেবল হুমকি ও বল প্রয়োগের ভাষাই বোঝে,” বলেছেন তিনি।
হামলার পর ট্রাম্প একে ‘চমকপ্রদ সামরিক সাফল্য’ অ্যাখ্যা দিয়ে ইরানের মূল পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা ‘পুরোপুরি ও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে’ বলে জোর গলায় বলেছিলেন।
কিন্তু তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না। উপগ্রহের ছবিতে মাটির অনেক গভীরে থাকা ফোরদো স্থাপনাটির উপরে থাকা পাহাড়ের গায়ে গর্ত দেখা গেলেও ভেতরে আদৌ কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
ট্রাম্প অবশ্য রোববার ফের দাবি করেছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনীর হামলা ছিল ‘পুরোপুরি অব্যর্থ’।
জাতিসংঘের পারমাণবিক ওয়াচডগ, আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা (আইইএই) বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বাইরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়তে দেখা যায়নি।
রোববার ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগে দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল কাউন্সিলের অনুমোদন লাগবে বলে জানিয়েছে ইরানের প্রেস টিভি।
এই সঙ্কীর্ণ জলসীমাটি আংশিক বন্ধ করে দিলেও তা উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বিশ্বের অন্যত্র তেল সরবরাহে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাবে, যার দরুন বিশ্বজুড়ে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইরান এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে তাদের সঙ্গে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম বহরের সংঘাত অনুমিতভাবেই বাধবে, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর এই বহরের ঘাঁটি উপসাগরেই, এবং তাদের দায়িত্বই হচ্ছে হরমুজ প্রণালী খোলা রাখা।
সামরিকভাবে তুলনামূলক হয়ে পড়া ইরান বোমা হামলা বা সাইবার হামলাসহ অন্য যে কোনোভাবে বদলা নেওয়ার কথাও ভাবতে পারে বলে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করছেন।
যুদ্ধের লক্ষ্য বদলে গেছে?
এ মাসের ১৩ তারিখ ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় আচমকা আঘাত হানা ইসরায়েলের কর্মকর্তারা গত কয়েকদিন ধরে প্রায়ই বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ১৯৭৯ সাল থেকে ইরানে শাসন করে আসা কট্টরপন্থি শিয়া মুসলিম মোল্লাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা।
কিন্তু রোববার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক হুমকি নির্মূল করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, তা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন।
ইরাকে ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের জনপ্রিয়তা কমতে দেখা মার্কিন প্রশাসনের বর্তমান কর্মকর্তাদের অনেকেই জোর গলায় বলছেন, তারা ইরানের সরকার ফেলে দিতে কাজ করছেন না।
“রেজিম চেঞ্জের জন্য এই অভিযান হয়নি, হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন,” বলেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ।