কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় উজানের পানিতে ফেনীর ফুলগাজী-পরশুরামে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর দুইটি স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে এ ভাঙন সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বণিকপাড়া সহদেব বৈদ্যের বাড়ি সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধের একটি স্থানে ও গোসাইপুর এলাকায় সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে উত্তর বরইয়া, দক্ষিণ বরইয়া, বণিকপাড়া, বসন্তপুর ও জগতপুর এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
এছাড়া এদিন সন্ধ্যা থেকে ফুলগাজী তরকারি বাজার সংলগ্ন স্থানে মুহুরী নদীর পানি প্রবেশ করে বাজারের একটি অংশ প্লাবিত হয়েছে। একইদিন দুপুর থেকে পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মনিপুর এলাকায় সিলোনিয়া নদীর পানি বেড়ে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে।
২০২৪ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার ১০ মাস না পেরোতেই আবারো বাঁধে ভাঙনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়সারা কাজকেই দুষছেন স্থানীয়রা। ইতোমধ্যে গত বন্যার পর আট মাস পার হয়ে গেলেও মেরামতের কাজ শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্লাবন ও বন্যার আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত পার করতে হচ্ছে নদীগুলো তীরবর্তী বসবাসকারী ৩০/৪০ হাজার মানুষকে।
রাজু নামে বরইয়া এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই নদীর পানি বাড়তে শুরু করে।
স্থানীয়দের নিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ভাঙন ঠেকানো যায়নি। গত বছরের বন্যার এক বছর না পেরোতেই আবারো আমরা পানিতে ডুবছি। কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলে এ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। শামীম নামে ফুলগাজী বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, এখানে প্রতিবছর জুন থেকে আগস্ট মাসে সামান্য বৃষ্টিতেই লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। দোকানের জিনিসপত্র পানিতে ভিজে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। কাউকে কিছু বলেও কি হবে। এসবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আবদুল মান্নান নামের মনিপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, কর্মকর্তারা বন্যা এলে ঘটনাস্থলে এসে জিও ব্যাগ দিয়ে মেরামতের কথা বললেও বন্যা শেষে আর খবর রাখেনি। আজও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করার খবরে কর্মকর্তারা এসে ঘুরে গেছে। কিন্তু আমাদের ভাগ্য কখনো সুখকর হয় না।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই বৃষ্টিপাতে নদী টইটুম্বুর হওয়ার কথা না। উজানের পানির কারণেই নদীর পানি বাড়তে পারে।
এলাকাবাসী জানান, গত ২৪ এর বন্যার ভয় মানুষের মন থেকে এখনো যায়নি। বন্যা, পানি এসব কথা শুনলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মনে আতঙ্ক বিরাজ করে। বন্যা দুর্গত এলাকাবাসী ফুলগাজী, পরশুরামের তিনটি নদীর মধ্যে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য বিগত সরকারের কাছে যতবারই দাবি জানিয়েছেন, ততবারই কোনো না কোনোভাবে বাঁধ নির্মাণ করে মোটা অংকের টাকা লুটপাট করেছেন। কাজের কাজ কিছুই করেন নাই। এসব লুটপাট করে নেতাদের পকেট ভারী হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সকল ভাঙ্গন এলাকা সংস্কার না করা গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফেনী পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ইতোমধ্যে ২০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ফুলগাজী, পরশুরামের এ প্রকল্পের পুনর্বাসনের জন্য ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়েছে। এ প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পুনর্বাসন না হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা কখনোই ফুলগাজী পরশুরামের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে দুর্ভোগ তা লাগব হবে বলে মনে হয় না। একটি পরিকল্পিত টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা গেলে এ সব এলাকায় বন্যা ও মানুষের দুর্ভোগ লাগব করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এ ব্যাপারে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পানি বাড়ছে। তবে মুহুরী নদীর পানি এখনো বিপদসীমার নিচে রয়েছে। বাঁধের ভাঙনস্থল রক্ষায় স্থানীয়দের নিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের নিরাপত্তায় আমাদের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের উত্তর বরইয়া মুহুরী নদীতে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লা পূর্বাঞ্চলের অতিঃ প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ জানান, প্রকল্প নয় ছয় করার কোনো সুযোগ নাই, এবার আমাদের যে কাজগুলো হবে এগুলো স্বচ্ছতার সাথে করার জন্য আমরা নির্দেশনা দিয়ে দিব। বন্যার পরিস্থিতি দেখার জন্য গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ফুলগাজী ও পরশুরামের ভাঙ্গন কবলিত সিলোনিয়া, মুহুরী ,কহুয়া নদীর ভাঙ্গা বাঁধগুলি পরিদর্শন করেন।
এ সময় ফেনী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাঈল হোসেন ও ফুলগাজী উপজেলার ইউএনও ফাহরিয়া ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।