অক্টোবরের দুই তারিখ। দুই হাজার তেরো। এ দিন গিয়েছিলাম দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল ভ্রমণে। সেখান থেকে ফেরার পথে রেলগাড়ি যখন ভৈরব সেতুর উপর দিয়ে কু ঝিক ঝিক … খটাশ খটাশ শব্দ তুলে পার হচ্ছিল, তখনই একটি পরিকল্পনা এঁটেছিলাম- অল্প দিনের মধ্যেই ভৈরবে মাছের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখব। সহযাত্রী ফয়সাল ভাই এতে আপত্তি করেননি, বরং অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। কারণ যান্ত্রিক নগর জীবনে ব্যস্ততার মাঝে ফাঁক ফোকোড় পেলেই নতুন জায়গা, নতুন নতুন মানুষ ও নানান বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করতে প্রায়ই হাওয়া হয়ে যাওয়া তার অভ্যাস।
মাত্র ক’দিন বাদে অর্থাৎ সেই মাসেরই তেরো তারিখ দুজনে মিলে রওনা দিলাম। বিমানবন্দর স্টেশনের প্লাটফর্মে ঠিক সময় মতো রেলগাড়ি ঢুকে পড়ল। তার আগে অবশ্য মাইকে কিছু একটা ঘোষণা করা হলো। কিন্তু সেটা রেলগাড়ি আসার খবর নাকি উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে বাতাসা বিতরণের সংবাদ, ঠিক বুঝতে পারলাম না। যাকগে, সে দিয়ে আমার কোনো দরকার নেই। হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে গাড়িতে উঠে বসলাম নির্দিষ্ট আসনে। এগিয়ে চললো জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।
আড়তে বিক্রির অপেক্ষায় বিভিন্ন জাতের মাছ
কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আলাদা করেছে মেঘনা নদী। এপারে কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ওপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ। মেঘনার বুকে অল্প দূরত্বে পাশাপাশি দুটি সেতু, একটি রেল অপরটি সড়ক সেতু। রেল সেতুটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত, পায়ে হেঁটে পারাপারের সুবিধার্থে রয়েছে সরু পথ। এক সময় সেতুটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল সেতু ছিল। ওপারে আশুগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে নামলাম। উঁচু স্টেশনের পাশে নিচু শহর, সেদিকে মনোনিবেশ না করে সড়ক সেতু ধরে পায়ে হেঁটে পার হয়ে চলে এলাম ভৈরব। দীর্ঘ সেতু, কিছু কমবেশি এক কি.মি. হবে। রোদের তীব্রতায় সেতুর পাটাতন যেন গনগন করছে!
ভৈরবে মাছের বাজার জমে ওঠে মূলত বিকেল পাঁচটার পর থেকে। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমরা আগেই চলে এসেছি। সুতরাং মাঝের সময়টুকু কাজে লাগাতে হবে। ভৈরব শহরটা মোটামুটি ভালো চেনে এমন একটা রিকশা নিয়ে দেড় ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালাম। এর মধ্যে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। হাওরের তাজা মাছের স্বাদ নিতে শহরে একের পর এক রেস্তোরাঁয় ঢুঁ দিলাম। অবাক করা বিষয় হলো, কোথাও হাওরের মাছের তরকারি রান্না হয় না! শেষ অবধি যদিও তার প্রকৃত হেতুটা আবিষ্কার করতে পারিনি, তবে অনুমান করে নিতে অসুবিধা হলো না অধিক লাভ না হওয়াই এর বড় কারণ। একেই বলে কপাল! মাছের জন্য বিখ্যাত পাইকারি বাজারের শহরে গিয়ে খেতে হলো বার্মিজ মাছ!
ভৈরব রেল ও সড়ক সেতু
খাওয়া শেষে গিয়ে বসি কয়লা খালাসের ঘাটে। ছোট্ট ঘাটে দাঁড়ালে নদীর ওপারে সেতুর গোড়ায় পাখির দৃষ্টিতে দেখা যায় আশুগঞ্জ শহর। আরও দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পর সেতু পেরিয়ে শহরের পেটে ঢুকে যাচ্ছে দড়ির মতো একেকটা রেলগাড়ি। সারি বেঁধে খালাসীরা ট্রলার থেকে ঝাঁকা ভরে কয়লা খালাস করছে। কয়লার কালিতে তাদের শরীরে কালো প্রলেপ পড়ে আছে। দেখে মনে হয়, যেন তারা নিজেরাই একেকটা কয়লার টুকরো। একজন শ্রমিক বলেন, আশ্বিন মাস পানিতে টান ধরেছে, বাজারে প্রচুর মাছ দেখতে পাবেন এখন।
ঘড়ির কাটা পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। হেঁটে গিয়ে প্রবেশ করি আড়ত পট্টিতে। ইতিমধ্যেই মাছ আসতে শুরু করেছে। দেশে মিঠাপানির মাছের প্রায় তিনশ প্রজাতির মধ্যে প্রায় একশ ষাট প্রজাতির মাছ এই হাওর এলাকায় পাওয়া যায়। হাওরাঞ্চলে মাছের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার মোহনগঞ্জ ও ভৈরব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারণে ইতিমধ্যেই হাওরের অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপরও দৈনিক যে পরিমাণ মাছের যোগান হাওরাঞ্চল থেকে আসে তা দেশের অনেক এলাকার মানুষের চাহিদা পূরণ করে।
ভৈরবে মাছের বাজার জমে ওঠে বিকেল বেলা
আমরা ক্রেতা বা বিক্রেতা কোনোটাই নই, কেবল একের পর এক ছবি তুলছি আর মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, জানার চেষ্টা করছি নানান কিছু। দুই কিশোর সুশান্ত ও নয়ন যেন এমনতর মানুষ জীবনে প্রথম পেয়েছে। স্বাগ্রহে ঘুরে দেখালো বাজারের প্রতিটি গলি। ব্যস্ত বাজারে কেউ টুকরি ভরে বয়ে আনছে মাছ। কেউ লাঠি দিয়ে ধুম ধাম শব্দে বরফের চাক ভাঙায় মগ্ন। আবার কেউবা মাছের স্তুপের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতা আকর্ষণে বয়ান করে যাচ্ছে মাছের গুণ ও মান। বোয়াল, রুই, গজার, শোল থেকে শুরু করে বাইন, টেংরা, পুঁটি, বাইলা এবং বাহারী রং এর বউ মাছসহ হরেক প্রজাতির মাছ দেখলাম। এতো দিন জানতাম ইলিশ কেবল সমুদ্র এবং পদ্মাতেই মেলে। ভৈরব গিয়ে সে ভুল ভাঙলো।
আড়তে মাছ বাছাইয়ে ব্যস্ত শ্রমিক
পরিমাণে কম হলেও হাওরের জলেও ইলিশ পাওয়া যায়। স্তুপ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাছাই করে আলাদা করার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অধিকাংশই দেখলাম নারী ও শিশু। অন্য কাজের পাশাপাশি খণ্ডকালীন হিসেবে তারা মাছের আড়তে শ্রম বিক্রি করে। বিনিময়ে মেলে কিছু বাড়তি টাকা এবং কখনও কখনও খাওয়ার জন্য যৎসামান্য গুঁড়ো মাছও তারা পায়। আড়তের মাছ বিক্রেতা থেকে শুরু করে শ্রমিক- সকলেই খুশি। সুতরাং ছবি তোলার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। তাদেরও দেখলাম আগে থেকেই পোজ দিয়ে বসে আছে। ব্যস্ততার মাঝেও আড়তদারদের অনেকেই ভালোবাসার দাবি জানিয়ে বললেন, ভাই, অনুগ্রহ করে আমার দোকানে এক কাপ চা খাবেন! তিন ঘণ্টার বাজার ভ্রমণে কমপক্ষে দশ দোকানের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয়েছে।