ঢাকা ০৬:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংশোধন হচ্ছে সরকারি চাকরি আইন রাজপথে সভা-সমাবেশ ও সচিবালয়ে বিক্ষোভ করলে চাকরি যাবে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:০১:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫
  • ১২ বার

অন্তর্বর্তী সরকার ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আনতে যাচ্ছে। এতে সাড়ে চার দশক আগের সামরিক আমলে প্রণীত ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯’-এর কয়েকটি ধারা ফের যুক্ত হচ্ছে। এটি করা হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের রাজপথে সভা-সমাবেশ, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি বন্ধ করতে। অন্য কর্মচারীকে তাদের কর্মস্থলে যেতে বাধা না দিতে এবং সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ বন্ধ করতে।

সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী উল্লেখিত অপরাধে অভিযুক্ত হলে কোনো তদন্ত ছাড়াই আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে সরকারি কর্মচারীদের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ এ সংশোধনের কাজ করছে। সংশোধিত খসড়া আইন শিগগির উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, ‘সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এটি তোলা হবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। একাধিক ক্যাডারের কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান, অনেকে দেশ ছাড়েন। অনেক কর্মচারী অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। কেউ কেউ আবার অন্যদের অনুপস্থিত থাকতে প্ররোচিত করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চায়। সংশোধিত খসড়ায় বলা হচ্ছে, কোনো কর্মচারী যদি নিজে অনুপস্থিত থাকেন, অন্যকে অনুপস্থিত থাকতে উসকানিও দেন কিংবা দাপ্তরিক শৃঙ্খলা বিঘ্ন করেন, তাহলে তিনি অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন। তদন্ত ছাড়াই তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে। প্রয়োজনে পদাবনতি কিংবা বেতন কর্তনের মতো শাস্তিও দেওয়া যাবে।

সংশোধিত খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভিযুক্ত কর্মচারীকে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হবে। চাইলে ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগ মিলবে। এর পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে দোষী মনে করলে তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আট দিনের মধ্যে সরকারি চাকরি হারাতে পারেন কোনো কর্মচারী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অনেক কর্মকর্তা ওএসডি হন, অনেকে বিক্ষোভে জড়ান। কেউ কেউ আবার সচিবালয়ের বারান্দায় শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানান। এসব ঘটনায় প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সংশোধিত আইনের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে চায় সরকার। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। কারো ভিন্নমত বা অভিযোগ প্রকাশ করাকেও ‘সরকারবিরোধিতা’ হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তি দেওয়া হতে পারে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন এক জন জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমার চাকরির মেয়াদ এখনো ২৫ বছর হয়নি। তাই সরকার চাইলেও আমাকে অবসরে পাঠাতে পারছে না। নতুন আইনের মাধ্যমে হয়তো সেই পথ তৈরি হচ্ছে।’ বর্তমান ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’-এর ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, ২৫ বছর চাকরির পর সরকার জনস্বার্থে কাউকে অবসরে পাঠাতে পারে। তবে নতুন সংশোধনীতে ২৫ বছর পূর্ণ না হলেও নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ আইন মানেই হচ্ছে ‘কালো আইন’-এর ঝুঁকি।

সাবেক সচিব ও লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দায়িত্ব পালন না করলে ব্যবস্থা নিতে হবে ঠিকই, তবে কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা উচিত।’ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আইনের অপব্যবহার রোধে সরকারকে সুনির্দিষ্ট গ্যারান্টি দিতে হবে।’

সংগঠনটির সমন্বয়ক মফিজুর রহমান বলেন, ‘এই সরকার তো গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছে। তাহলে এখন কেন কর্মচারীদের মুখ বন্ধ রাখতে চায়? এটা তো ফ্যাসিবাদের আলামত।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সংশোধন হচ্ছে সরকারি চাকরি আইন রাজপথে সভা-সমাবেশ ও সচিবালয়ে বিক্ষোভ করলে চাকরি যাবে

আপডেট টাইম : ১০:০১:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকার ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আনতে যাচ্ছে। এতে সাড়ে চার দশক আগের সামরিক আমলে প্রণীত ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯’-এর কয়েকটি ধারা ফের যুক্ত হচ্ছে। এটি করা হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের রাজপথে সভা-সমাবেশ, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি বন্ধ করতে। অন্য কর্মচারীকে তাদের কর্মস্থলে যেতে বাধা না দিতে এবং সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ বন্ধ করতে।

সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী উল্লেখিত অপরাধে অভিযুক্ত হলে কোনো তদন্ত ছাড়াই আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে সরকারি কর্মচারীদের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ এ সংশোধনের কাজ করছে। সংশোধিত খসড়া আইন শিগগির উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, ‘সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এটি তোলা হবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। একাধিক ক্যাডারের কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান, অনেকে দেশ ছাড়েন। অনেক কর্মচারী অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। কেউ কেউ আবার অন্যদের অনুপস্থিত থাকতে প্ররোচিত করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চায়। সংশোধিত খসড়ায় বলা হচ্ছে, কোনো কর্মচারী যদি নিজে অনুপস্থিত থাকেন, অন্যকে অনুপস্থিত থাকতে উসকানিও দেন কিংবা দাপ্তরিক শৃঙ্খলা বিঘ্ন করেন, তাহলে তিনি অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন। তদন্ত ছাড়াই তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে। প্রয়োজনে পদাবনতি কিংবা বেতন কর্তনের মতো শাস্তিও দেওয়া যাবে।

সংশোধিত খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভিযুক্ত কর্মচারীকে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হবে। চাইলে ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগ মিলবে। এর পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে দোষী মনে করলে তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আট দিনের মধ্যে সরকারি চাকরি হারাতে পারেন কোনো কর্মচারী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অনেক কর্মকর্তা ওএসডি হন, অনেকে বিক্ষোভে জড়ান। কেউ কেউ আবার সচিবালয়ের বারান্দায় শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানান। এসব ঘটনায় প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সংশোধিত আইনের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে চায় সরকার। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। কারো ভিন্নমত বা অভিযোগ প্রকাশ করাকেও ‘সরকারবিরোধিতা’ হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তি দেওয়া হতে পারে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন এক জন জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমার চাকরির মেয়াদ এখনো ২৫ বছর হয়নি। তাই সরকার চাইলেও আমাকে অবসরে পাঠাতে পারছে না। নতুন আইনের মাধ্যমে হয়তো সেই পথ তৈরি হচ্ছে।’ বর্তমান ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’-এর ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, ২৫ বছর চাকরির পর সরকার জনস্বার্থে কাউকে অবসরে পাঠাতে পারে। তবে নতুন সংশোধনীতে ২৫ বছর পূর্ণ না হলেও নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ আইন মানেই হচ্ছে ‘কালো আইন’-এর ঝুঁকি।

সাবেক সচিব ও লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দায়িত্ব পালন না করলে ব্যবস্থা নিতে হবে ঠিকই, তবে কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা উচিত।’ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আইনের অপব্যবহার রোধে সরকারকে সুনির্দিষ্ট গ্যারান্টি দিতে হবে।’

সংগঠনটির সমন্বয়ক মফিজুর রহমান বলেন, ‘এই সরকার তো গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছে। তাহলে এখন কেন কর্মচারীদের মুখ বন্ধ রাখতে চায়? এটা তো ফ্যাসিবাদের আলামত।’