দেড়শ শতক জমিতে এক হাজার মণেরও বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। এবার ভালো ফলন পেয়েছি। কিন্তু আলু বিক্রি করতে পারিনি।
“বস্তায় ভরে দুই-এক মণ করে নিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছি। পাঁচশ মণের মত আলু এখনও বাড়ির উঠানে রয়ে গেছে।”
কথাগুলো বলছিলেন, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের মিথলমা গ্রামের ফাহিমা আক্তার।
ফাহিমার স্বামী কৃষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “বীজ আলু কেনা হয়েছে ১৭৫ টাকা কেজি। পরে বীজ আলু লাগিয়ে প্রতি মণ আলু চাষে খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে ৭৫০ টাকার মত।
“এখন আমি বাজারে গিয়ে দাম পাচ্ছি মণে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রতি মণে আমাকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। তাহলে কি আমি লোকসানে আলু বিক্রি করব?”
সাজ্জাদ বলেন, “অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বাড়ির উঠোনে আলু জমা করে রেখেছি। যদি একটু দাম বাড়ে তাহলেই ছেড়ে দেব, আর যদি এর মধ্যে বৃষ্টি-বাদল শুরু হয় তাহলে সব শেষ।”
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় কৃষি জমি থেকে আলু তোলা চলে। সারাদেশে একই সঙ্গে আলুর ফলন তোলা শুরু হওয়ায়, কুমিল্লার কৃষকরা উত্তোলিত আলু জমা করেন নিজের বাড়ির ঘরে, উঠানে ও মাচানে।
ফাহিমা-সাজ্জাদের মত জেলার বহু কৃষক বছরজুড়ে সবটুকু শ্রম ঢেলে আলু ফলিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন। কৃষকদের আশা ছিল, এবার তারা বেশি দামে আলু বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু এক মাসের অপেক্ষার পরও দাম না বাড়ায় জমা করে রাখা আলু গরমে পচতে শুরু করেছে।
কৃষি অধ্যুষিত এলাকা বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের মিথলমা, আবিদপুর, মনঘাটা, শিকারপুর, পাঁচকিত্তা, হালাগাও, লোয়ার চর, কাকিয়ার চর গ্রামগুলোতে কৃষকের ঘরে ঘরে, পথে-ঘাটে হাজার হাজার মণ আলু পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
শুধু বুড়িচং নয়, দেবিদ্বার ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অনেক গ্রামেই এখনও বাড়ি বাড়ি আলু জমে আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হওয়ায় মৌসুমে চাহিদা কমে গেছে। ফলে দামও কমে গেছে। স্থানীয় কোল্ড স্টোরেজগুলোতেও জায়গা না পাওয়াও এখন নষ্ট হবার উপক্রম।
সরকারিভাবে এসব উদ্বৃত্ত আলু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে রাখা গেলে, মৌসুম শেষে যখন আলুর দাম বেড়ে যায় তখন টিসিবি কিংবা ন্যায্যমূল্যের দোকানে এই আলু বিক্রি করা যেতে পারে। এতে কৃষক যেমন ক্ষতি থেকে বাঁচবে, তেমনি সঙ্কটে মানুষ কম দামে আলু পাবে।
জমির পাশে উঁচু খোলা জায়গায় আলু স্তূপ করে রেখেছেন বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের মিথলমা গ্রামের প্রবীণ কৃষক মো. মোস্তফা মিয়া।
তিনি বলছিলেন, “আমরা ধারণা করছি, শুধু মিথলমা গ্রামে কমপক্ষে ২৫ হাজার মণ আলু এখনো মজুদ রয়েছে। তাহলে আশপাশের গ্রামে কী পরিমাণ আলু মজুদ আছে তা তো ধারণার বাইরে! মৌসুমে আমরা এখন সর্বনিম্ন ১৩ টাকা কেজি পাইকারি দরে বিক্রি করছি, বাজারে তা অন্তত ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি করে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুম শেষে মজুদ কমে আসলে এই আলুর কেজি দাঁড়ায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। স্থানীয় কৃষকরা যদি নিজেরা এই আলু সংরক্ষণ করতে পারতো তাহলে মজুতদারদের পরিবর্তে কৃষকরাই লাভবান হত।”
কৃষক ওয়ালি উল্লাহ বলেন, “সরকার যেভাবে মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করে মজুদ রাখে, সরকারিভাবে আলু মজুদও রাখা যেতে পারে। তাহলে মৌসুম শেষে সরকারিভাবে আলু ন্যায্যমূল্যে ভোক্তাদের কাছে বিক্রিও করা যাবে।
“উৎপাদনকারী কৃষক যেমন লাভবান হবে, তেমনি ভোক্তারাও ঠকবে না। কৃষকদের কাছে সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় মাঝখান থেকে লাভবান হয় আড়তদার ও মজুতদাররা।”
মিথলমা গ্রামে আরেক আলু চাষি সুমন বলেন, “শখের বসে ৪২ শতক জমিতে আলু লাগিয়েছিলাম। ভালো ফলনও হয়েছে। সবকিছু বাদ দিয়ে এখনও ৬০ মণ আলু রয়ে গেছে। অন্য মৌসুমে এসে আলু কিনে নিয়ে যায়, এবার কেউই আসছে না।”
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শুনেছি নিমসার বাজারে উত্তরবঙ্গ থেকে আনা আলু বেশি বিক্রি হচ্ছে। তাই স্থানীয় চাষিদের আলু বাজারে উঠছে না। নিমসার বাজারে কিংবা কোল্ড স্টোরেজের সামনে উত্তরবঙ্গ থেকে যে আলু আসে, সেগুলোর জন্য পরিবহন খরচ কিংবা শ্রমিকের ব্যয় নেই বিধায় তাদের প্রতি আড়তদারদের আগ্রহ থাকে বেশি।
“কিন্তু গ্রাম থেকে আলু সংগ্রহ করতে হলে শ্রমিক খরচ এবং পরিবহন দুটোই লাগে, তাই তারা এদিকে আগ্রহ দেখায় না।”
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাঁচা বাজার নিমসার বাজার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নে অবস্থিত। কৃষকদের অভিযোগ, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা আলু পরিবহন খরচসহ অন্যান্য খরচ দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা যায়। যারা ট্রাকে করে আলু পাঠান সে আলুর সংরক্ষণের দায়িত্ব তাদেরই থাকে। বিক্রি না হলে পচে যাওয়ার ক্ষতির দায় না থাকায় আড়তদাররা বাইরে থেকে আসা আলু ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিয়ে থাকেন বেশি।
অন্যদিকে যারা আলু বেসরকারিভাবে মজুদ করেন তাদের আলু দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে স্থানীয় কোল্ডস্টোরেজগুলো। একদিকে আড়তদারদের কাছে চাহিদা নেই স্থানীয় আলুর, অপরদিকে কোল্ড স্টোরেজে নেই জায়গা। মাঝখানে বিপুল পরিমাণ আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা।
নিমসার বাজারের আলুর আড়তদার মো. আজিম বলেন, “সারা বাংলাদেশের কোল্ডস্টোরেজের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। জানা মতে, কোথাও জায়গা নেই। তারপরও সরকার যদি খোঁজ নিয়ে কোল্ডস্টোরেজগুলোতে জায়গা করতে পারে তাহলে আমাদের স্থানীয় আলু রাখার ব্যবস্থা করা যাবে। তাহলে কৃষক বাঁচবে। এই বিপুল পরিমাণ আলু পচনের হাত থেকে বাঁচানো গেলে আলুর দাম মানুষের নাগালের মধ্যে সারা বছরই থাকবে।”
ব্যবসায়ীরা কেন স্থানীয় আলু ক্রয়-বিক্রয় করতে চান না জানতে চাইলে আজিম বলেন, “কুমিল্লার আলুর চেয়ে উত্তরবঙ্গের আলুর আকার বড় এবং সুন্দর হয়। যে কারণে ব্যবসায়ীরা ওই আলুর প্রতি শুরুর দিকে আগ্রহ দেখায়। উত্তরের মজুদ শেষ হলে পরে স্থানীয় আলু কেনাবেচা শুরু হবে। কিন্তু ততদিনে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ে যেতে পারেন।”
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলছেন, এ বছর জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ২৫৪ হেক্টর জমি। উৎপাদন হয়েছে নয় হাজার ৬১ একর জমিতে। ফলন উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৯০ হাজার ৭৮ টন; যা গত বছরের তুলনায় বেশি।
তিনি বলেন, “এবার যেসব জমিতে আলু চাষ হয়েছে ফলন খুবই ভালো হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ আলু এখনও অবিক্রিত রয়ে গেছে, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।”
আইউব বলেন, “আমরা পরামর্শ দিতে পারি, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সহযোগিতায় তিন-চার মাস ‘দেশীয় পদ্ধতিতে’ (আলুর নিচে পলিথিন ও শুকনো চটের বস্তা দিয়ে উঁচু জায়গায় সংরক্ষণ করা) আলু সংরক্ষণ করে দুই-তিন মাস রাখা যেতে পারে। তবে স্থায়ীভাবে এই উদ্বৃত্ত আলু সরকারিভাবে মজুদ করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। না হলে কৃষকের ঘাম ঝরানো ফলন যেমন পচে যাবে, তেমনি দেশের খাদ্য মজুদেও ভাটা পড়বে।”
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, “আমরা চেষ্টা করব বেসরকারি কোল্ড স্টোরেজগুলোতে আলু সংরক্ষণ করা যায় কি-না। এছাড়া সরকারি কোল্ড স্টোরেজেও কোনো জায়গা থাকলে সেখানে সব কৃষকদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আমরা খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছি।”
তিনি বলেন, “সরকারিভাবে আলু সংগ্রহের কাজটি একদিনে সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।”