ঢাকা ০২:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে তীব্র বিতর্ক: ১২তম দিনে গড়ালো কপ২৯ সম্মেলন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:০৬:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
  • ১৪ বার

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলমান জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ২৯ গতকাল শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে তীব্র মতবিরোধের কারণে তা ১২তম দিনে গড়িয়েছে।

সম্মেলনের মূল আলোচনা বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ নিয়ে তীব্র বিতর্কের মাঝে থমকে আছে। আজকের মধ্যে একটি নতুন খসড়া প্রস্তাবনা আসার কথা থাকলেও আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ও তা বণ্টন নিয়ে অবস্থান এখনও পরিষ্কার হয়নি। এটি সম্মেলনটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল শুক্রবার কপ২৯ সম্মেলনে উপস্থাপিত নতুন খসড়া প্রস্তাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের বার্ষিক লক্ষ্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। তবে, এই লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বার্ষিক অর্থায়নের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো।

বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই প্রস্তাবনাকে ‘অপ্রতুল’ ও ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন, তাদের জন্য ঋণের বদলে অনুদান জরুরি, অন্যথায় তাদের অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে।’

মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধি টিনা স্টেগ খসড়াকে টেক্সটকে ‘লজ্জাজনক’ অভিহিত করে এই প্রস্তাবনাকে বৈশ্বিক জলবায়ু সুবিচারের পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন।

জলবায়ু অর্থায়নে প্রস্তাবিত টেক্সটকে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘এই খসড়া টেক্সট জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করা দেশগুলোর জন্য অসম্মানজনক। আমাদের জন্য বাস্তব অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন, যা আমাদের অভিযোজন এবং ক্ষয়-ক্ষতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সবুজ অর্থনীতিতে ন্যায্য রূপান্তরে সহায়তা করবে।’

প্রস্তাবনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কথা বলা হলেও এর মধ্যে উন্নত দেশগুলোর জন্য বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি অর্থায়ন আসবে বেসরকারি বিনিয়োগ ও অন্যান্য উৎস থেকে। তবে আফ্রিকা, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং জি৭৭+চায়না গোষ্ঠীর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এই প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে আরও বেশি, নির্দিষ্ট ও প্রাপ্তিযোগ্য সহায়তার দাবি করেছে।

বেসরকারি সংস্থা ও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা খসড়া প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করতে বলছেন। তারা দাবি করছেন, যে কোনো আর্থিক সহায়তা প্রক্রিয়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। শুক্রবার রাতে কিছু পরিবেশ আন্দোলনকারী সম্মেলনস্থলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সেখানে তারা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ও ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল দ্বীপ (এসআইডিএস) দেশগুলোর জন্য আরও তহবিলের দাবি করেন।

বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ অভিযোজন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের জন্য আরও অর্থায়নের জোর দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই তহবিলগুলোকে ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘এই তহবিলগুলোকে যথাযথভাবে অনুদান হিসেবে দেওয়া না হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আর্থিক চাপে পড়বে এবং তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ব্যাহত হবে।’

সম্মেলনে চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) নিজেদের সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীন ঘোষণা করেছে, তারা বছরে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে যা তাদের জলবায়ু পরিকল্পনাগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হবে। ইউএই আরও ১৬.৮ বিলিয়ন ডলার নতুন তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে, যা তাদের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে।

অতিরিক্ত দিনে গড়ানোর কারণে বাকুতে কপ২৯ সম্মেলন কেন্দ্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, যা সম্মেলনের কার্যক্রম ব্যাহত করছে। আয়োজক দেশ আজারবাইজান পরিবহন ও অন্যান্য সেবা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন অধিবেশন ও আলোচনায় যোগ দিতে পারছেন না। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি ও আন্দোলনকারীরা এই অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তা দ্রুত নিরসনের দাবি জানিয়েছেন।

কপ২৯ সম্মেলনের চূড়ান্ত ফলাফল জলবায়ু অর্থনৈতিক সহায়তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, যা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ন্যায্য হিস্যার জন্য লড়াই করছে, এবং প্রত্যাশা করছে এ সম্মেলন থেকে তাদের জন্য একটি কার্যকর সমাধান বের হবে। তাই, সবার চোখ এখন আজারবাইজানের দিকে, কপ২৯ কি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে তীব্র বিতর্ক: ১২তম দিনে গড়ালো কপ২৯ সম্মেলন

আপডেট টাইম : ১১:০৬:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলমান জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ২৯ গতকাল শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে তীব্র মতবিরোধের কারণে তা ১২তম দিনে গড়িয়েছে।

সম্মেলনের মূল আলোচনা বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ নিয়ে তীব্র বিতর্কের মাঝে থমকে আছে। আজকের মধ্যে একটি নতুন খসড়া প্রস্তাবনা আসার কথা থাকলেও আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ও তা বণ্টন নিয়ে অবস্থান এখনও পরিষ্কার হয়নি। এটি সম্মেলনটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল শুক্রবার কপ২৯ সম্মেলনে উপস্থাপিত নতুন খসড়া প্রস্তাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের বার্ষিক লক্ষ্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। তবে, এই লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বার্ষিক অর্থায়নের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো।

বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই প্রস্তাবনাকে ‘অপ্রতুল’ ও ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন, তাদের জন্য ঋণের বদলে অনুদান জরুরি, অন্যথায় তাদের অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে।’

মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধি টিনা স্টেগ খসড়াকে টেক্সটকে ‘লজ্জাজনক’ অভিহিত করে এই প্রস্তাবনাকে বৈশ্বিক জলবায়ু সুবিচারের পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন।

জলবায়ু অর্থায়নে প্রস্তাবিত টেক্সটকে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘এই খসড়া টেক্সট জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করা দেশগুলোর জন্য অসম্মানজনক। আমাদের জন্য বাস্তব অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন, যা আমাদের অভিযোজন এবং ক্ষয়-ক্ষতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সবুজ অর্থনীতিতে ন্যায্য রূপান্তরে সহায়তা করবে।’

প্রস্তাবনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কথা বলা হলেও এর মধ্যে উন্নত দেশগুলোর জন্য বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি অর্থায়ন আসবে বেসরকারি বিনিয়োগ ও অন্যান্য উৎস থেকে। তবে আফ্রিকা, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং জি৭৭+চায়না গোষ্ঠীর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এই প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে আরও বেশি, নির্দিষ্ট ও প্রাপ্তিযোগ্য সহায়তার দাবি করেছে।

বেসরকারি সংস্থা ও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা খসড়া প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করতে বলছেন। তারা দাবি করছেন, যে কোনো আর্থিক সহায়তা প্রক্রিয়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। শুক্রবার রাতে কিছু পরিবেশ আন্দোলনকারী সম্মেলনস্থলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সেখানে তারা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ও ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল দ্বীপ (এসআইডিএস) দেশগুলোর জন্য আরও তহবিলের দাবি করেন।

বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ অভিযোজন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের জন্য আরও অর্থায়নের জোর দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই তহবিলগুলোকে ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘এই তহবিলগুলোকে যথাযথভাবে অনুদান হিসেবে দেওয়া না হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আর্থিক চাপে পড়বে এবং তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ব্যাহত হবে।’

সম্মেলনে চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) নিজেদের সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীন ঘোষণা করেছে, তারা বছরে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে যা তাদের জলবায়ু পরিকল্পনাগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হবে। ইউএই আরও ১৬.৮ বিলিয়ন ডলার নতুন তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে, যা তাদের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে।

অতিরিক্ত দিনে গড়ানোর কারণে বাকুতে কপ২৯ সম্মেলন কেন্দ্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, যা সম্মেলনের কার্যক্রম ব্যাহত করছে। আয়োজক দেশ আজারবাইজান পরিবহন ও অন্যান্য সেবা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন অধিবেশন ও আলোচনায় যোগ দিতে পারছেন না। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি ও আন্দোলনকারীরা এই অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তা দ্রুত নিরসনের দাবি জানিয়েছেন।

কপ২৯ সম্মেলনের চূড়ান্ত ফলাফল জলবায়ু অর্থনৈতিক সহায়তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, যা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ন্যায্য হিস্যার জন্য লড়াই করছে, এবং প্রত্যাশা করছে এ সম্মেলন থেকে তাদের জন্য একটি কার্যকর সমাধান বের হবে। তাই, সবার চোখ এখন আজারবাইজানের দিকে, কপ২৯ কি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।