ঢাকা ০৬:১৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাবুল রহস্যের শেষ কোথায়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:০৩:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬
  • ৩৩৬ বার

সদ্য অব্যাহতি পাওয়া পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল রহস্যের শেষ কোথায়? এমন প্রশ্ন খোদ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরতদের। একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। স্ত্রী খুন হওয়ার পর তিন মাসের মাথায় চাকরি চলে যাওয়া এবং সর্বশেষ গ্রেফতারের আশঙ্কায় সবখানেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এসপি বাবুল আক্তার।

স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তার জড়িত, এমন তথ্য পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইঙ্গিত দিলেও প্রকাশ্য কোনো বক্তব্য আসেনি তাদের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে বাবুলের শ্বশুর পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশারফ হোসেন এবং শ্যালিকা শায়লা মোশারফ একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলে আসছেন বাবুল আক্তারকে ফাঁসানো হচ্ছে।

বাবুলের বাবা আবদুল ওয়াদুদ, শ্বশুর এবং শ্যালিকা সাংবাদিকদের কাছে বলে আসছেন বাবুল আক্তারের জীবন এখন হুমকির মুখে। স্ত্রী হত্যার পর চাকরি চলে যাওয়ায় তার (বাবুল) আর কোনো অবলম্বন রইলো না। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সে এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। যেকোনো সময় তাকে হত্যা করা হতে পারে।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্র বলছে, বাবুল আক্তার স্ত্রী মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত। সোর্সের মাধ্যমে স্ত্রীকে কৌশলে হত্যা করে বাঁচার চেষ্টা করেছে। স্ত্রী হত্যা মামলায় নিজে বাদি হওয়ায় এবং সেসময় চট্টগ্রাম মেট্রােপলিটন পুলিশসহ (সিএমপি) পুরো পুলিশ বাহিনী এটিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দেশব্যাপী সাঁড়াশী অভিযান চালায়। মামলার তদন্তের গভীরতায় গিয়ে বাবুলের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়। এরপরই নড়েচড়ে উঠে পুলিশের উর্দ্ধতনরা। যে কারণে বাবুলকে ডেকে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে ১৬ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেসময় তাকে চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিলো।

অপরদিকে পুলিশের একটি পক্ষ মনে করছে বাবুলকে হয়তো ভিন্ন কারণে স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। এর পিছনে কারণ জানতে চাইলে তারা বলছেন, তাদের ধারণা তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তবে এবিষয়ে মুখ খুলতে চাননা তারা।

বাবুল আক্তারকে যে প্রক্রিয়ায় চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে এবিষয়ে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তাতে সবার কাছে পুরো বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ভিন্ন ভিন্ন আলোচনায় বলছেন বাবুল আক্তারের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ! এবিষয়ে পুলিশ এবং সরকারের পক্ষ থেকে খোলাসা করা উচিত।

মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাবুলের চাকরির অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘন্টা নিখােঁজ ছিলেন। এতোটা সময় তিনি কোথায় ছিলেন সেবিষয়টাই অজানা রয়ে গেছে। বাবুল বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো কিছুই বলা হচ্ছেনা। তবে বাবুলের শ্বশুর বলেছেন বাবুল বুধবার বাসায় ফিরে আসে এবং এসেই দোতলায় চলে যান, কারোর সাথেই কোনো কথা বলেননি।

বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এক নিদের্শনা জারি করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মাদ ইলিয়ান হোসেন।

প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ২৪তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে যোগদানকৃত মো. বাবুর আক্তার (বিপি ৭৫০৫১০৯০২৯) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, সিএমপি, চট্টগ্রাম (বর্তমানে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত এবং পুলিশ সদরে দফতরে সংযুক্ত)-কে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে চাকরি (পুলিশ ক্যাডার) হতে এতদ্বারা অব্যাহতি প্রদান করা হলো। জনস্বার্থে অবিলম্বে এ আদেশ কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।

গত ৩ ও ৪ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে গিয়ে তিনি চাকরি ছাড়ার বিষয়ে একটি লিখিত ব্যাখ্যা দেন। এরপরও তাকে চাকরি যোগদান করতে না দেওয়ায় পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেন। পাশাপাশি আগের দেওয়া পদত্যাগপত্র জোর করে নেওয়া হয়েছে তাও লিখিত দেন তিনি।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অপরাগতায় লিখিত আবেদন করেও ৩ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে কাজে যোগ দিতে না পেরে ৪ আগস্ট সদর দফতরে ডিআইজি (প্রশাসন) বরাবর লিখিতভাবে যোগদানপত্র জমা দেন। যোগদানপত্রে তিনি বলেন, স্ত্রী খুন হওয়ার পর দুই সন্তানের দেখাশোনার জন্য কর্মকর্তাদের পরামর্শ মতো তিনি শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে দুই সন্তানকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছেও নেওয়া হচ্ছে। অনুপস্থিতির সময়টা ছুটি হিসেবে নিয়ে তাকে কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করেন বাবুল।

পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদান করতে না পেরে সই করা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে আবেদন করেন বাবুল। আবেদনে তিনি বলেন, বিগত ২৪ জুন পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরির অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুশোক, সদ্য মা-হারা দুটি শিশুর ব্যাকুলতায় প্রতিকূল ও বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমি চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করি। ওই অব্যাহতিপত্রটি প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি, যা আমি স্বেচ্ছায় দাখিল করিনি।

এর আগে, স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিনের মাথায় গত ২৪ জুন মধ্যরাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবুলকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ২৫ জুন ১৬ ঘণ্টা কথা বলার পর তাকে বনশ্রীতে শ্বশুরের বাসায় পৌঁছে দেয় ডিবি। ওই সময় তার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নেওয়া হয় বলেও সূত্র জানায়। সূত্র আরও জানিয়েছিল বাবুল নিজেই চাকরি ছাড়ার শর্তে স্ত্রী হত্যার দায় থেকে বাঁচতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু শিশু সন্তানের সামনে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন। স্ত্রী খুন হওয়ার দিন বাবুল আক্তার ঢাকার পুলিশ সদর দফতরেই কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। ঘটনার পর থেকে দুই শিশু সন্তান নিয়ে রাজধানীর বনশ্রীর ভূঁইয়া পাড়ায় শ্বশুরের বাসাতে এখন পর্যন্ত বসবাস করে আসছেন।

গত ৩১ আগস্ট বাবুল আক্তারকে চাপ প্রয়োগে চাকরির পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া প্রসঙ্গে আইজিপি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জোর করে নেওয়া হয়নি, স্বেচ্ছায় বাবুল আক্তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আমরা তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর আমরা দেড় মাস অপেক্ষা করেছিলাম। তিনি এটা প্রত্যাহার করেন কিনা। তবে তিনি কোনও ব্যবস্থা নেননি। এর আগে গত ২১ জুলাই চট্টগ্রামে আইজিপি বলেছিলেন, শুনেছি, বাবুল আক্তার মানসিকভাবে বিষন্নতায় ভুগছেন। চাকরি করার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই।

বাবুল আক্তারের চাকরির অব্যহতিপত্রে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি একাধিকবার বলেছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই বাবুল আক্তার চাকরি থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

পুলিশের ২৪তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে র‌্যাব-২ এ কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার পদেও কর্মরত ছিলেন।

পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর বদলি হয়ে সিএমপিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দিয়ে দক্ষিণ সুদান গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই তিনি দেশে ফিরে নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করেন।

এছাড়া সিএমপির অপরাধ দমনে আলোচিত চৌকস এ পুলিশ কর্মকর্তাকে চাহিদাপত্র দিয়ে সিএমপিতে আনেন পুলিশ কমিশনার আব্দুল জলিল মণ্ডল। এরপর ছুটি কাটিয়ে ২৬ আগস্ট সিএমপিতে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে যোগদান করেন।

চট্টগ্রাম ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) বাবুল আক্তার গত এপ্রিল মাসে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) হন। ঢাকার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে যোগদানের প্রথম দিনেই চট্টগ্রামে তার স্ত্রীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

বাবুল আক্তার ১৯৭৫ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপার মদনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়া ও মা শাহিদা বেগম। ২০০৪ সালে মাহমুদা আক্তারের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন তিনি। তাদের সংসারে দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির ও আক্তার তাবাচ্ছুম তানজিলা। মাহির ক্যান্টেনমেন্ট পাবলিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

পরিশ্রমী, দায়িত্বের প্রতি একনিষ্ঠতা এবং সততার জন্য তিনি পেয়েছেন সাফল্যের নানা স্বীকৃতি। ২০০৮ সালে সুপারস্টার ‘বাবুল’ রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা), ২০০৯ সালে পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেলই (বিপিএম-সাহসিকতা) যার প্রমাণ।

সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেন বাবুল আক্তার। এর মধ্যে চার-চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) মর্যাদা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বাবুল রহস্যের শেষ কোথায়

আপডেট টাইম : ০১:০৩:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সদ্য অব্যাহতি পাওয়া পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল রহস্যের শেষ কোথায়? এমন প্রশ্ন খোদ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরতদের। একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। স্ত্রী খুন হওয়ার পর তিন মাসের মাথায় চাকরি চলে যাওয়া এবং সর্বশেষ গ্রেফতারের আশঙ্কায় সবখানেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এসপি বাবুল আক্তার।

স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তার জড়িত, এমন তথ্য পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইঙ্গিত দিলেও প্রকাশ্য কোনো বক্তব্য আসেনি তাদের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে বাবুলের শ্বশুর পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশারফ হোসেন এবং শ্যালিকা শায়লা মোশারফ একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলে আসছেন বাবুল আক্তারকে ফাঁসানো হচ্ছে।

বাবুলের বাবা আবদুল ওয়াদুদ, শ্বশুর এবং শ্যালিকা সাংবাদিকদের কাছে বলে আসছেন বাবুল আক্তারের জীবন এখন হুমকির মুখে। স্ত্রী হত্যার পর চাকরি চলে যাওয়ায় তার (বাবুল) আর কোনো অবলম্বন রইলো না। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সে এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। যেকোনো সময় তাকে হত্যা করা হতে পারে।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্র বলছে, বাবুল আক্তার স্ত্রী মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত। সোর্সের মাধ্যমে স্ত্রীকে কৌশলে হত্যা করে বাঁচার চেষ্টা করেছে। স্ত্রী হত্যা মামলায় নিজে বাদি হওয়ায় এবং সেসময় চট্টগ্রাম মেট্রােপলিটন পুলিশসহ (সিএমপি) পুরো পুলিশ বাহিনী এটিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দেশব্যাপী সাঁড়াশী অভিযান চালায়। মামলার তদন্তের গভীরতায় গিয়ে বাবুলের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়। এরপরই নড়েচড়ে উঠে পুলিশের উর্দ্ধতনরা। যে কারণে বাবুলকে ডেকে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে ১৬ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেসময় তাকে চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিলো।

অপরদিকে পুলিশের একটি পক্ষ মনে করছে বাবুলকে হয়তো ভিন্ন কারণে স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। এর পিছনে কারণ জানতে চাইলে তারা বলছেন, তাদের ধারণা তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তবে এবিষয়ে মুখ খুলতে চাননা তারা।

বাবুল আক্তারকে যে প্রক্রিয়ায় চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে এবিষয়ে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তাতে সবার কাছে পুরো বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ভিন্ন ভিন্ন আলোচনায় বলছেন বাবুল আক্তারের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ! এবিষয়ে পুলিশ এবং সরকারের পক্ষ থেকে খোলাসা করা উচিত।

মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাবুলের চাকরির অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘন্টা নিখােঁজ ছিলেন। এতোটা সময় তিনি কোথায় ছিলেন সেবিষয়টাই অজানা রয়ে গেছে। বাবুল বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো কিছুই বলা হচ্ছেনা। তবে বাবুলের শ্বশুর বলেছেন বাবুল বুধবার বাসায় ফিরে আসে এবং এসেই দোতলায় চলে যান, কারোর সাথেই কোনো কথা বলেননি।

বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এক নিদের্শনা জারি করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মাদ ইলিয়ান হোসেন।

প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ২৪তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে যোগদানকৃত মো. বাবুর আক্তার (বিপি ৭৫০৫১০৯০২৯) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, সিএমপি, চট্টগ্রাম (বর্তমানে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত এবং পুলিশ সদরে দফতরে সংযুক্ত)-কে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে চাকরি (পুলিশ ক্যাডার) হতে এতদ্বারা অব্যাহতি প্রদান করা হলো। জনস্বার্থে অবিলম্বে এ আদেশ কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।

গত ৩ ও ৪ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে গিয়ে তিনি চাকরি ছাড়ার বিষয়ে একটি লিখিত ব্যাখ্যা দেন। এরপরও তাকে চাকরি যোগদান করতে না দেওয়ায় পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেন। পাশাপাশি আগের দেওয়া পদত্যাগপত্র জোর করে নেওয়া হয়েছে তাও লিখিত দেন তিনি।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অপরাগতায় লিখিত আবেদন করেও ৩ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে কাজে যোগ দিতে না পেরে ৪ আগস্ট সদর দফতরে ডিআইজি (প্রশাসন) বরাবর লিখিতভাবে যোগদানপত্র জমা দেন। যোগদানপত্রে তিনি বলেন, স্ত্রী খুন হওয়ার পর দুই সন্তানের দেখাশোনার জন্য কর্মকর্তাদের পরামর্শ মতো তিনি শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে দুই সন্তানকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছেও নেওয়া হচ্ছে। অনুপস্থিতির সময়টা ছুটি হিসেবে নিয়ে তাকে কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করেন বাবুল।

পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদান করতে না পেরে সই করা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে আবেদন করেন বাবুল। আবেদনে তিনি বলেন, বিগত ২৪ জুন পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরির অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুশোক, সদ্য মা-হারা দুটি শিশুর ব্যাকুলতায় প্রতিকূল ও বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমি চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করি। ওই অব্যাহতিপত্রটি প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি, যা আমি স্বেচ্ছায় দাখিল করিনি।

এর আগে, স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিনের মাথায় গত ২৪ জুন মধ্যরাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবুলকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ২৫ জুন ১৬ ঘণ্টা কথা বলার পর তাকে বনশ্রীতে শ্বশুরের বাসায় পৌঁছে দেয় ডিবি। ওই সময় তার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নেওয়া হয় বলেও সূত্র জানায়। সূত্র আরও জানিয়েছিল বাবুল নিজেই চাকরি ছাড়ার শর্তে স্ত্রী হত্যার দায় থেকে বাঁচতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু শিশু সন্তানের সামনে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন। স্ত্রী খুন হওয়ার দিন বাবুল আক্তার ঢাকার পুলিশ সদর দফতরেই কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। ঘটনার পর থেকে দুই শিশু সন্তান নিয়ে রাজধানীর বনশ্রীর ভূঁইয়া পাড়ায় শ্বশুরের বাসাতে এখন পর্যন্ত বসবাস করে আসছেন।

গত ৩১ আগস্ট বাবুল আক্তারকে চাপ প্রয়োগে চাকরির পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া প্রসঙ্গে আইজিপি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জোর করে নেওয়া হয়নি, স্বেচ্ছায় বাবুল আক্তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আমরা তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর আমরা দেড় মাস অপেক্ষা করেছিলাম। তিনি এটা প্রত্যাহার করেন কিনা। তবে তিনি কোনও ব্যবস্থা নেননি। এর আগে গত ২১ জুলাই চট্টগ্রামে আইজিপি বলেছিলেন, শুনেছি, বাবুল আক্তার মানসিকভাবে বিষন্নতায় ভুগছেন। চাকরি করার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই।

বাবুল আক্তারের চাকরির অব্যহতিপত্রে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি একাধিকবার বলেছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই বাবুল আক্তার চাকরি থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

পুলিশের ২৪তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে র‌্যাব-২ এ কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার পদেও কর্মরত ছিলেন।

পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর বদলি হয়ে সিএমপিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দিয়ে দক্ষিণ সুদান গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই তিনি দেশে ফিরে নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করেন।

এছাড়া সিএমপির অপরাধ দমনে আলোচিত চৌকস এ পুলিশ কর্মকর্তাকে চাহিদাপত্র দিয়ে সিএমপিতে আনেন পুলিশ কমিশনার আব্দুল জলিল মণ্ডল। এরপর ছুটি কাটিয়ে ২৬ আগস্ট সিএমপিতে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে যোগদান করেন।

চট্টগ্রাম ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) বাবুল আক্তার গত এপ্রিল মাসে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) হন। ঢাকার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে যোগদানের প্রথম দিনেই চট্টগ্রামে তার স্ত্রীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

বাবুল আক্তার ১৯৭৫ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপার মদনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়া ও মা শাহিদা বেগম। ২০০৪ সালে মাহমুদা আক্তারের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন তিনি। তাদের সংসারে দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির ও আক্তার তাবাচ্ছুম তানজিলা। মাহির ক্যান্টেনমেন্ট পাবলিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

পরিশ্রমী, দায়িত্বের প্রতি একনিষ্ঠতা এবং সততার জন্য তিনি পেয়েছেন সাফল্যের নানা স্বীকৃতি। ২০০৮ সালে সুপারস্টার ‘বাবুল’ রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা), ২০০৯ সালে পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেলই (বিপিএম-সাহসিকতা) যার প্রমাণ।

সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেন বাবুল আক্তার। এর মধ্যে চার-চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) মর্যাদা।