মজলুমের প্রতি মহান রাব্বুল আলামিনের যে বিশেষ করুণা ও সাহায্যের ওয়াদাÑ এটি মজলুমের মহা প্রাপ্তি, যেটি সে কেবল মজলুম হওয়ার কারণেই লাভ করেছে। আর এটিই মজলুম হওয়ার সুফল। তবে এ সুফল লাভ করা ও ধরে রাখার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, যেগুলো পূরণ করা জরুরি। নতুবা সুফল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। নি¤েœ এ ধরনের কিছু শর্ত ও করণীয় বিষয় উল্লেখ করা হলোÑ
১. তাকওয়া, সবর ও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা : আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিছুটা বিলম্বে হলেও তিনি মজলুমকে সাহায্য করবেন। তাই সঙ্কটকালীন সময়টুকুতে তার করণীয় হলো হতাশ ও ধৈর্যহারা না হওয়া; বরং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা, সবর করা এবং তাকওয়া অবলম্বন করা। এ বিষয়গুলো যে কোনো সময়েই জরুরি; তবে মজলুম অবস্থায় আরো বেশি জরুরি। কুরআন মাজিদে মজলুমদেরকে এসব বিষয়ে বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে।
ফেরাউন যখন বনি ইসরাইলকে হত্যার ঘোষণা দিলো তখন মুসা আলাইহিস সালাম তাদের এই বলে নসিহত করলেন : তোমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও ও ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চয় ভূমি আল্লাহর। তিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। আর শেষ পরিণাম মুত্তাকিদেরই অনুকূলে থাকে। (সূরা আ’রাফ : ১২৮) অতএব মজলুমকে আল্লাহর নাফরমানি ও সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যক্তি জুলুমের শিকার হলে ব্যক্তিকে গুনাহ থেকে বাঁচতে হবে আর জাতি জুলুমের শিকার হলে পুরো জাতিকে গুনাহ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
২. জুলুম থেকে পরিত্রাণের পর আল্লাহর শোকর করা এবং তার হুকুম মোতাবেক চলা : মজলুমিয়াতের সুফল এবং আল্লাহর করুণা ধরে রাখার জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে জালেমের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। অতএব এখন কর্তব্য হলোÑ আল্লাহর শোকর করা, বাকি জীবন তার হুকুম মোতাবেক চলা এবং নাফরমানিতে লিপ্ত না হওয়া। হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে মুক্তির সুসংবাদ দেয়ার পাশাপাশি এ বিষয়েও সতর্ক করেছিলেন
বলেছিলেন, আল্লাহ তোমাদের মুক্ত করবেন, এরপর দেখবেন তোমরা কেমন আমল করো। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে : তারা (বনি ইসরাইল) বলল, আমরা আপনার আগমনের আগেও নির্যাতিত হয়েছি এবং আপনার আগমনের পরেও। তিনি (মুসা) বললেন, শিগগিরই তোমাদের রব তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করে দেবেন এবং এ দেশে তোমাদেরকে (তাদের) স্থলাভিষিক্ত করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন আমল করো। (সূরা আ’রাফ : ১২৯)
কিন্তু হতভাগা বনি ইসরাইল সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ করল। আল্লাহ তায়ালা বলেন : আমি বনি ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। এরপর তারা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছল, যারা তাদের মূর্তিপূজায় রত ছিল। (তখন) বনি ইসরাইল বলল, মুসা! এদের যেমন দেবতা আছে, তেমনি আমাদের জন্যও কোনো দেবতা বানিয়ে দিন। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় তোমরা মূর্খ লোক!’ নিশ্চয় এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তারা যা করছে সবটাই ভ্রান্ত। তিনি (আরো) বললেন, আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য খুঁজে আনব? অথচ তিনিই তোমাদের সমগ্র বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন? (সূরা আ’রাফ : ১৩৮-১৪০)
৩. সীমালঙ্ঘন না করা ও সীমালঙ্ঘনে সহযোগিতা না করা : এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আল্লাহ তায়ালা মজলুমকে অনুমতি দিয়েছেন, সে জুলুম থেকে রক্ষা পেতে এবং নিজের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে ন্যায়সঙ্গতভাবে চেষ্টা-তদবির এবং প্রতিবাদ ও প্রতিহত করতে পারবে। এটি করতে গিয়ে সে যদি মারাও যায়, সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে।
সাঈদ ইবনে জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিতÑ নবি (সা.) ইরশাদ করেন : যে তার সম্পদ রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। যে তার দ্বীন রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। যে তার প্রাণ রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ এবং যে তার পরিবার রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। (জামে তিরমিজি : ১৪২১) তবে সেই সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, জালেমের প্রতিও সীমালঙ্ঘন করা যাবে না; বরং তার সঙ্গেও ইনসাফ ও ন্যায়ের আচরণ করতে হবে।
মক্কার মুশরিকরা নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কত নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। কত সাহাবিকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। তাদেরকে ঘরছাড়া, দেশছাড়া, সম্পদছাড়া এবং পরিবারছাড়া করেছে। মসজিদে হারাম, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রবেশের অনুমতি ছিল, সেখানেও তাদের যেতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আদেশ হলোÑ তোমরা তাদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করবে না।
আর কেউ যদি সীমালঙ্ঘন করতে চায়, তাকে তোমরা সাহায্য করবে না। কুরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদেরকে মসজিদে হারামে (প্রবেশ করতে) বাধা দিয়েছিল, এই কারণে (বাধাদানকারী) সম্প্রদায়ের প্রতি তোমাদের যে শত্রুতা, তা যেন তোমাদেরকে (তাদের প্রতি) সীমালঙ্ঘন করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ায় পরস্পরকে সাহায্য করবে; গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা। (সূরা মায়িদা : ২)