ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। আর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূসের দায়িত্ব নেয়ার দুই মাস পার হয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাসীর কাছে নিজেকে আস্থার ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, উল্টো প্রতিযোগীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২৪ সালের প্রথম আট মাস জানুয়ারি-আগস্টে বাজারটিতে বাংলাদেশসহ শীর্ষ পাঁচ রফতানিকারক দেশেরই রফতানি কমেছে। তবে অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের রফতানি অনেক বেশি কমেছে। যদিও এই আট মাসই ছিল স্বৈরাচার হাসিনার দুঃশাসন। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো এই সুবিধা ফিরিয়ে আনতে পারেনি বাংলাদেশ। আওয়ামী সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপড়েন দূর করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপিসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে আর্থিক খাতে দেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এখনই সেই সুযোগ এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে শ্রম পরিবেশ উন্নত করার যে শর্তের কথা বলে জিএসপি তুলে নেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগ এরই মধ্যে পূরণ করা হলেও শ্রম অধিকারের কিছু বিষয় নিয়ে হাসিনা সরকারের সময়ে নানাবিধ টানাপড়েনে আপত্তির জায়গা তুলে ধরত যুক্তরাষ্ট্র। যার কারণে হয়তো এই সুবিধা মেলেনি বাংলাদেশের জন্য। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয়ায় সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশ সাহায্য করতে মুখিয়ে আছে। আর তাই এখন জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ বলে আশাবাদী পোশাক খাত-সংশ্লিষ্টরা।
ভারতে পলায়নকারী হাসিনার সময়ে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক আমদানি করেছেন। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে মোট ৪৭১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। এই রফতানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে দেশটিতে ৭২৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে এই বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক। তৈরি পোশাকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা এখন ৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে চীন। তাদের দখলে রয়েছে পোশাকের ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ বাজার হিস্যা। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে এক হাজার ৬৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে দেশটি, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম।
মার্কিন বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানিকারক ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ পাঁচ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশের মধ্যে ভিয়েতনামই দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তারা আলোচ্য জানুয়ারি-আগস্ট আট মাসে ৯৫৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের ৯৬৬ কোটি ডলারের রফতানির চেয়ে ১ শতাংশ কম।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে চতুর্থ ও পঞ্চম শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক যথাক্রমে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার রফতানিও কমেছে। গত জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে ভারত রফতানি করেছে ৩২১ কোটি ডলারের পোশাক। তাদের রফতানি কমেছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার রফতানি কমেছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। তাদের রফতানির পরিমাণ ২৬৮ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৬৫ কোটি ডলার। ওই বছরের এপ্রিলে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর দেশটিতে পোশাক রফতানি কমে যায়। তবে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আবার অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি বাড়তি শুল্ক থেকে বাঁচতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। মাঝে করোনার ধাক্কার পর ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রেকর্ড ৯৭২ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আবার রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এ বছরের কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা ও শ্রম অসন্তোষের কারণে টানা তিন মাস পোশাক খাতের উৎপাদন ও রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নিয়ে আশাবাদী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নিয়ে আশাবাদী। তার মাধ্যমে আমরা যদি দেশটি থেকে কোনো ধরনের শুল্ক সুবিধা নিতে পারি, তাহলে আমাদের রফতানি বাড়বে।
বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর ইউএসটিআরএর একটি দলের সঙ্গে আগেও জিএসপি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেখানে মার্কিন প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এটি প্রত্যাহার করা গেলে তৈরি পোশাক শিল্পে রফতানি আরো বাড়ত। কিন্তু তখন স্বৈরাচার হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকায় এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নমনীয়তা দেখায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয়ার পর এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টার এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফরে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ।
খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি ছিল মানবাধিকার ও শ্রমিকদের বিষয়ে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। শ্রমিক, মালিক ও সরকারÑ তিন পক্ষ মিলে কাজ করছে। ইতোমধ্যে সব কিছুর সফল সমাধান হয়েছে। তিনি বলেন, জিএসপি না পাওয়ার জন্য এই খাতের কোনো ব্যর্থতা তিনি দেখেন না। কারণ যেসব শর্ত বেধে দেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগই পূরণ করা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, জিএসপি সুবিধা থাকলে আমদানির শুল্ক দেয়ার প্রয়োজন হয় না। ফলে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের পণ্যগুলো প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পায়। সেটি মাথায় রেখে অন্য আমদানিকারকরাও বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। তাই জিএসপি সুবিধা বহাল হলে বাংলাদেশের পোশাক খাত তথা দেশের ইমেজ সঙ্কট দূর হবে। এই সুবিধা ফিরে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।