দেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে কেউ বলেন একটি রাজনৈতিক মাছ। কেউ বলেন এটি একটি কূটনৈতিক মাছ। শিক্ষকের বেতনে বড় একটি ইলিশ মাছও কেনা যায় না। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের একজন শিক্ষক বেতন পান মাত্র ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোতে শিক্ষকদের বেতন দিয়ে নিবন্ধিত ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষকের মাসিক অনুদান ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। সহকারী ও জুনিয়র শিক্ষকের মাসিক অনুদান ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভারত, পাকিস্তান এমনকি নেপালের চেয়েও কম বেতন পান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থা আরও করুণ। এসব প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতার কোনো নীতিমালা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে ঠকছেন সেখানকার শিক্ষকরা। মাধ্যমিক স্কুলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে মূল বেতন পেলেও নন-এমপিও শিক্ষকরা বিনা বেতনে এই পেশায় রয়েছেন বছরের পর বছর।
বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের অবস্থা আরও খারাপ। অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষকদের এমপিও দেয় না সরকার। দীর্ঘদিন ধরেই এমপিওর দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। এ ছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পার্টটাইম শিক্ষকদের দিয়েই চলছে। সেখানকার নিয়মিত শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নেই।
দেশে শিক্ষকদের এমন নানা বৈষম্যের মধ্যেই আজ ৫ অক্টোবর উদযাপন হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ইউনেস্কো ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবরকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষায় কণ্ঠস্বর : শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’।
সংবিধানে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা
বাধ্যতামূলক হলেও সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আর প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যেখানে একজন গাড়িচালকও সমান মর্যাদা ও বেতন-ভাতা পায়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্ত (সরকারি বেতন-ভাতার অংশ) শিক্ষকরা বেতন পেলেও বাড়ি ভাড়া পান ৫০০ ও চিকিৎসা ভাতা পান মাত্র ৩০০ টাকা। এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মূল বেতনের মাত্র ২৫ শতাংশ প্রতি ঈদে উৎসব ভাতা পান। নন-এমপিও শিক্ষকরা আরও বেশি বেতনবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বেশিরভাগ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। এমপিওভুক্তির দাবিতে এই শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন।
অন্যদিকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন মাত্র ৫০০ টাকা। ঢাকাসহ সারা দেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে। সরকারের কোনো নজরদারি না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও বেতনের নীতিমালা নেই। শিক্ষার্থী ভর্তিতে গলাকাটা বেতন-ফি আদায় করলেও শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হয়।
শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন-মহান পেশা ‘শিক্ষকতা’ এখন আকর্ষণহীন। বেতনবৈষম্যের কারণে মেধাবীরা এখন আর শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী হন না। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়ছে। তাই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আফ্রিকার দরিদ্র দেশের চেয়েও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম বাংলাদেশে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কভুক্ত নেপাল এবং ভুটানে যেখানে শিক্ষা খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ১১ শতাংশ। ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ (কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বরাদ্দ মিলে) আরও বেশি। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে সচেষ্ট দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি হলো মালদ্বীপ। জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখছে এই দেশটি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের প্রায় ১২ লাখ শিক্ষক নানা সংকট নিয়ে সার্বক্ষণিক শিক্ষাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শিক্ষা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। এতে গুণী শিক্ষকদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শনিবার বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন নীতিমালা-২০২৪’ অনুসারে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে এ দিবস উদযাপন করা হবে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনার করে শিক্ষক দিবস উদযাপন হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ উদ্যোগে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা ও শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীসহ সবার শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান বৃদ্ধির জন্য সচেতনতা তৈরিতে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অংশীজনরা এতে অংশ নেবেন। দিবসটি উপলক্ষে শিক্ষক সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের শিক্ষক সমাবেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য অসংখ্য ভালো শিক্ষকের প্রয়োজন। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিকল্প নেই। মেধাবীদের এই পেশায় আনতে চাইলে পেশাকে আকর্ষণীয় করতে হবে। শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষার পরিবর্তনটি আনতে হবে।