লেগস্টাম্পের ওপর বল ফেললেন আঘা সালমান, পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্যাডল সুইপ করলেন জাকির হাসান। ডিপ ফাইনলেগ দিয়ে বল সীমানাছাড়া। ওতেই সারা হলো পাকিস্তান জয়ের ইতিকথা।
রাওয়ালপিন্ডিতে টিম বাংলাদেশ উদযাপন করল, তবে অবিস্মরণীয় জয়ের আনন্দও সীমা ছাড়াল না। কারণটা পরিষ্কার-ভয়াবহ বন্যাসহ আরও কিছু কারণে দেশবাসী যে অস্বস্তিকর একটা সময় পার করছে। তবে পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের আনন্দ কিন্তু জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তির পরশ বুলিয়েছে।
রোববার পাকিস্তানকে ১০ উইকেটে হারিয়েছে টিম বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে এবারই প্রথম তাদের কেউ এত বড় ব্যবধানে হারের লজ্জা দিল। অথচ আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ৪৪৮ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান। পিন্ডির উইকেট বোলারদের দিকে সামান্য নজর দিতেই দ্বিতীয় ইনিংসে ছন্নছাড়া স্বাগতিক শিবির। অসাধারণ বোলিংয়ে ১৪৬ রানেই শান মাসুদের দলকে গুটিয়ে দেয় টাইগাররা। ম্যাচসেরা মুশফিকুর রহিমের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে ৫৬৫ রান তোলা শান্তর দল তাতে জয়ের জন্য পায় ৩০ রানের লক্ষ্য। দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম আর জাকির হাসান ৬.৩ ওভারেই দলকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। রান তাড়ায় এই প্রথম টেস্টে জয় দেখল টাইগাররা।
এর নেপথ্যে ছিল দলীয় প্রচেষ্টা। ব্যাটিং-বোলিং আর ফিল্ডিং-তিন বিভাগেই বাংলাদেশ ছিল উজ্জ্বল। পাকিস্তান বড় রানের বোঝা চাপিয়ে দিলেও ব্যাটাররা ভড়কে যাননি। মুশফিকুর রহিমের ১৯১ রানের অনবদ্য ইনিংসের সঙ্গে সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, লিটন দাস আর মেহেদী হাসান মিরাজের দুর্দান্ত ব্যাটিংশৈলীতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বোচ্চ দলীয় পুঁজির রেকর্ডটা নতুন করে লিখে ফেলে শান্ত ব্রিগেড। সপ্তম উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে রেকর্ডগড়া ১৯৬ রানের জুটির পথে হাফসেঞ্চুরি পাওয়া মিরাজ ভেলকি দেখিয়েছেন বল হাতেও। তার পাশাপাশি সাকিব আল হাসান, শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানারাও ছিলেন দুর্দান্ত। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই পাকিস্তান আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
মুশফিক-সাদমানদের দুর্দান্ত ব্যাটিং প্রদর্শনীর পর এই টেস্ট থেকে বাংলাদেশের হারের শঙ্কা উবে গিয়েছিল আগেই। তবে শেষ দিনের খেলা যখন শুরু, তখনও ড্রয়ের পাল্লাই ছিল ভারী। শেষতক অবশ্য প্রথম ইনিংসে পাওয়া বাংলাদেশের ১১৭ রানের লিডটাই ভারী হয়ে উঠে পাকিস্তানের ওপর। স্বাগতিকরা দিন শুরু করে ৯৪ রানে পিছিয়ে থেকে, ১ উইকেটে ২৩ রান নিয়ে। দুটি সেশন ব্যাটিংয়ে কাটিয়ে দিলেই হয়তো হার এড়াতে পারত পাকিস্তান। টাইগার বোলাররা তাদের সেই সুযোগটাই দেননি। প্রথম সেশনেই তারা তুলে নেন পাঁচ উইকেট। দিনের শুরুতেই পাকিস্তান অধিনায়ক মাসুদকে ফেরান হাসান। এরপর একবার জীবন পাওয়া বাবর আজমকে বোল্ড করেন নাহিদ।
সাকিবের (৩/৪৪) বাঁহাতের ভেলকি যখন শুরু, তখন আর হালে পানি পায়নি স্বাগতিকরা। সৌদ শাকিলকে রানের খাতা খুলতে দেননি তিনি। এরপর আবদুল্লাহ শফিক (৩৭) আর নাসিম শাহকেও ফেরান এই তারকা। তখন থেকেই মূলত জয়ের সুবাস পেতে শুরু করে শান্তর দল। ২১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মিরাজ তো দলকে পৌঁছে দেন জয়ের দোরগোড়ায়। আঘা সালমান আর শাহিন আফ্রিদিকে ফেরানোর পর এই অফস্পিনারই ভাঙেন মোহাম্মদ রিজওয়ানের প্রতিরোধ। পাকিস্তানের ঝুলিতে এই কিপার-ব্যাটার ৫১ রান জমা করেছিলেন বলেই ইনিংস ব্যবধানে জয় পায়নি বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আলিকে ফিরিয়ে মিরাজ স্বাগতিকদের ইনিংস গুটিয়ে দেওয়ার পরও তাই ছোট্ট লক্ষ্য তাড়ায় ব্যাট হাতে নামতে হয় সাদমান-জাকিরকে।
সপ্তম ওভারে সালমানের বলটিকে সুইপ করে জাকির যখন সীমানাছাড়া করেন, ধারাভাষ্যে থাকা আতাহার আলী তখন বলছিলেন-ইতিহাস গড়ল এই বাংলাদেশ। সুখস্মৃতি হয়ে ম্যাচটি আজীবন থেকে যাবে টাইগার ক্রিকেট পুরাণে। যেভাবে দুঃস্মৃতি হয়ে আছে ২০০৩ সালের মুলতান টেস্ট। জয়ের খুব কাছাকাছি থেকেও ইনজামাম উল হকের কারণে টেস্টটি এক উইকেটে হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ২১ বছর ধরে বয়ে চলা আক্ষেপ এবার কিছুটা হলেও ঘুচেছে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪তম টেস্টে এসে জয় দেখল বাংলাদেশ। সব সংস্করণ মিলিয়ে ২১ ম্যাচেও পাকিস্তানের মাটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে প্রথম জয় এটি। ১৪৩ টেস্টে ২০তম জয়। সবমিলে ৯টি দলের বিপক্ষে পাওয়া এই জয়গুলো। জিম্বাবুয়েকে দিয়ে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের পর পাকিস্তানকেও হারাল টাইগাররা। এখন বাকি কেবল দুটি দল-ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা।