২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: বিচারের অপেক্ষায় এক যুগ

যুগ পার হতে বাকি হাতেগোনা কয়েকদিন। সময়টা দীর্ঘ। তার চেয়ে ক্ষতটা আরও গভীর। দীর্ঘ এই সময়ে ঘটেছে কত না অঘটন। কিন্তু ২১ আগস্ট এলে এখনও বুকে জমা ব্যথায় ডুকরে ওঠেন অনেকে। যারা স্বজন হারিয়েছেন। হারিয়েছেন রাজনৈতিক সহযাত্রী, বন্ধু, সহকর্মী। স্মৃতি আজও অমলিন। সেদিনের ক্ষত আজও যারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের বেদনা কি কম? কি শরীর, কি মন, দুটোই ক্ষতবিক্ষত বোমার স্প্লিন্টারে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ হামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই যন্ত্রণাও তো কমার নয়। বিচার আজও শেষ হয়নি। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিসহ সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, আর মাস ছয় অপেক্ষা করতে হতে পারে রায়ের জন্য। হামলার মতোই পদে পদে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে বিচার প্রক্রিয়া। মূল দোষীদের বাইরে রেখে একবার বিচার প্রায় চূড়ান্ত হতে বসেছিল। থমকে গেছে। অধিকতর তদন্ত হয়েছে। এতে সময় লেগেছে প্রায় ছয় বছর। দু দফায় বিচারকের টেবিলে জমা পড়েছে অভিযোগপত্র। প্রথম দফার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় ফারাক বিস্তর। অভিযোগ আছে, ঘটনাটি ভিন্নখাতে চালিয়ে দিয়ে বিচারে জল মেশানোর পাঁয়তারা হয়েছিল।

ওই হামলা যাদের ঘিরে ছিল সেই আওয়ামী লীগ টানা প্রায় আট বছর দেশের ক্ষমতায়। এবার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দুটো মামলার বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য উদ্যোগ নেয়। এরও আগে চারদলীয় জোট সরকারের আমল শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরে মামলার গতিবিধি আদ্যোপান্ত ঘেঁটে দেখা যায় ‘জজ মিয়া’ নামে এক নাটক সাজিয়ে মূল হোতাদের নামই মামলার নথি থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। অধিকতর তদন্তের প্রসঙ্গ আসে সেখান থেকেই।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা যায় তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু বিষয় বাদ পড়ে গেছে। পরে আরও এক দফা তদন্ত শেষে মামলার সিআইডি যে অভিযোগপত্র আদালতে দিয়েছে তাতে আসামি হয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা। বিএনপির সতীর্থ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এরই মধ্যে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যুদ্ধাপরাধের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

২১ আগস্টের ঘটনায় করা দুটো মামলায় অভিযোগপত্রের ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২৩ জন এরই মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এখন চলছে ২২৪তম জনের সাক্ষী, সিআইডির এএসপি মো. ফজলুল কবীর। যিনি প্রথম অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে। গত ১ জুন থেকে তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন। শেষ হতে পারে চলতি মাসে। তারপরই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ সাক্ষ্য দেবেন। তার সাক্ষ্য শেষে রাষ্ট্রপক্ষ আর কোনো সাক্ষী না দিলে আত্মপক্ষ শুনানি এবং শেষে যুক্তিতর্ক শুনানির পরই রায়।

সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল সূত্র বলছে, আগামী ২১ আগস্ট মামলাটির এক যুগপূর্তি হলেও এর মধ্যে মামলার বাকি কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। বাকি কাজ শেষ হয়ে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক মাস। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান এই সময়কে বলেন, ‘কবে মামলার বিচার শেষে হবে তা বলা যাবে না। তবে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। তাই নির্দিষ্ট করে মামলার বিচার কবে শেষ হবে বলা সম্ভব নয়।’

মামলাটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষ্য নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে যাদের প্রয়োজন তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এবং হবে।’ রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী অভিযোগ করেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার প্রথমে মামলার তদন্ত ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবার অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও তা সম্পূর্ণ ছিল না। তাই ন্যায় বিচারের স্বার্থে মামলা দুটি অধিকতর তদন্তে যায়। দুই দফা তদন্তেই ছয় বছর সময় চয়ে যায়। অন্যদিকে আসামিপক্ষ বিচার বিলম্বের জন্য কয়েকদফা উচ্চ আদালতে গিয়েছে। এখনো তারা বিভিন্ন কৌশলে মামলার বিচার পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’ তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এই অভিযোগ একবাক্যে অস্বীকার করেছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষই বরং মামলা দুটোর বিচার শেষ করতে তড়িঘড়ি করছে। আমরাও এ মামলায় ন্যায় বিচার চাই। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সাহায্যই করছি।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন এই সময়কে বলেন, ‘জঘন্যতম এই অপরাধের বিচার যতদিন শেষ না হবে ততদিন এই ক্ষত রয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে যারা বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের প্রাপ্য সর্বোচ্চ সাজা। ন্যায় বিচার নিশ্চিত হলে জনগণের এই চাওয়া পূরণ হবে।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার জন্য যারা এত বড় ষড়যন্ত্র করতে পারে, বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা নিয়ে যারা অনুসন্ধান করেছেন তাদের মধ্যে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির অন্যতম। তিনি কারাগারে থাকা জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় বলেছি বঙ্গবন্ধুর হত্যা এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার ওপর উপর্যুপরি হামলা ও হত্যাপ্রচেষ্টা একই সূত্রে গাঁথা। একই উদ্দেশ্যে একই জায়গা থেকে পরিকল্পনা হচ্ছে, যা বাংলাদেশকে জিয়াউল হকের পাকিস্তান বা মোল্লা উমরের আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানানোর আগ পর্যন্ত চলবে।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘১৫ আগস্ট বা ২১ আগস্টের তদন্তে জামায়াত আইএসআইর নাম উচ্চারিত হয়নি। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে আইএসআই হচ্ছে গ্রাম্যবধূর ভাসুরের মতো, যে নাম কখনো উচ্চারণ করা যাবে না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু শেখ হাসিনা নয়, জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য অনেক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’

সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি যারা

তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, আলী আহসান মুজাহিদ, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান ও মো. ওবায়দুর রহমান, জোট সরকারের আমলে মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশিদকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া হুজির ১০ জন নেতা ও হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফও এই মামলার আসামি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আসামিদের মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৯ জন পলাতক এবং পুলিশের সাবেক ছয় কর্মকর্তা ও বিএনপি-সমর্থিত সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টুসহ ২৫ আসামি কারাগারে আছেন, আর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে জামায়াত নেতা মুজাহিদের।

তারেকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান এ মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের নভেম্বরে প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারেক রহমান ও বাবরসহ অন্যদের নাম বলেননি। এরপর ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা জবানবন্দিতে তিনি তারেকসহ বাকি রাজনীতিকদের নাম বলেন। সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুফতি হান্নান বনানীর হাওয়া ভবনে গিয়ে তারেক রহমান, আলী আহসান মুজাহিদ, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, রেজ্জাকুল হায়দার, আবদুর রহিমসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবর হামলায় অংশগ্রহণকারীদের প্রশাসনিক সহায়তা ও নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেন বলে অভিযোগ আনা হয়। আদালতে ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি সাক্ষ্যে বলেন, রেজ্জাকুল হায়দার বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বাবরের নির্দেশ পেয়ে ২১ আগস্ট ঘটনার রাতেই উদ্ধার হওয়া অবিস্ফোরিত গ্রেনেড দ্রুত ধ্বংস করে আলামত নষ্ট করা হয়।

সেদিন যা ঘটেছিল

দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সমাবেশ ছিল। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিল হওয়ার কথা ছিল। এ শান্তি মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার। মিছিল শুরুর আগ মুহূর্তে ট্রাকের উপর নির্মিত খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্র বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে তাকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। বিকট শব্দে একের পর এক বিস্ফোরিত হয় ১৩টি গ্রেনেড।

মৃত্যুর জাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। তারপরও শেখ হাসিনার গাড়িকে লক্ষ্য করে ১২টি গুলি ছুড়ে দুর্বৃত্তরা। নারকীয় ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন প্রাণ হারায়। আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। এখনও যাদের অনেকে শরীরে শত শত স্প্লিন্টারের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে দিন পার করছেন।

হামলাকালে শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মাথায় অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। প্রায় আড়াই বছর অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ এবং দেশ-বিদেশে চিকিৎসার পর ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর মারা যান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর