উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ সহজ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধামালা’য় সংশোধনী আনতে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়। খসড়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে বিদ্যমান ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সইযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার বিধান বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এই সুযোগ নিয়ে উপজেলা নির্বাচনে ভুঁইফোড় প্রার্থী ঠেকাতে জামানত কয়েকগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচনে যে সংখ্যক ভোট পড়বে, তার ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট না পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে জমার বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে প্রদত্ত ভোটের সাড়ে ১২ শতাংশ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান রয়েছে। ইসির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা এবং উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালায় কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব রয়েছে। ওইসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে আইন সংস্কার কমিটি। ওই কমিটির সুপারিশ কমিশন সভায় তোলা হবে।
জানা গেছে, উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রচারের সুযোগ দেওয়া এবং নির্বাচনী প্রচারের পোস্টারে পলিথিনের আবরণ বা প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারের বিষয়টি বিধিমালার আওতায় আনা হচ্ছে। জনসভা ও মিছিল আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনে মাইক ব্যবহারে শব্দের মানমাত্রাও বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নির্বাচনী প্রচারে রঙিন পোস্টার ও ব্যানার ব্যবহারের সুযোগ আবারও ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে এসব সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়।
জানা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের ২৭তম সভায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালার সম্ভাব্য সংশোধনীর বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। গতকাল নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার নেতৃত্বাধীন ‘আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি’র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এসব সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সুপারিশ কমিশন সভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠাবে।
নির্বাচন বিধিমালা সংশোধন
জানা গেছে, দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম?্যান পদে ভোট হওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৬ সালে ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা সংশোধন’ করা হয়। তখন থেকে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সইয়ের তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। এই সই জমা দেওয়ার বিধানের কারণে অনেকেই প্রার্থী হতে পারেন না। আবার ওই তালিকার গরমিল, স্বাক্ষরদাতাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে তা অস্বীকার করানোসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে প্রার্থিতা বাতিলের অনেক নজির রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বিধিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে কমিশন। এতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালার বিধি ১৫-তে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে, প্রার্থিতার সমর্থনে সইযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার ফলে ভোটারদের গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে জানিয়েছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা দলীয় কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে না। দল সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে ভোট করতে পারবেন।
এদিকে জাতীয় সংসদের আদলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও কিছু বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নির্বাচন বিধিমালার ৮০-‘ক’ বিধিতে নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের হুমকি, ভীতি ও বাধা দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অনিয়ম ও প্রভাব বিস্তার হলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে বিধিতে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। নির্বাচন বিধিমালায় আরও যেসব সংশোধনী প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- কেবল অনলাইন পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র দাখিল, নির্বাচনী ব্যয়সীমা বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ, পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং নির্বাচন প্রচার মনিটরিংয়ে কমিটি গঠন করা।
রঙিন পোস্টার-ব্যানারে ফিরতে চায় ইসি
জানা গেছে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালাতেও বড় ধরনের সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পোস্টারে পলিথিনের আবরণ এবং প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। নির্বাচনে শব্দদূষণ কমানোর লক্ষ্যে মাইকের সাউন্ড ৬০ ডেসিবেলের নিচে রাখার বিধান যুক্তের জন্য বলা হয়েছে। এ দুটি বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে ইসিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ১৫ বছর পর উপজেলা নির্বাচনে রঙিন পোস্টার ও ব্যানার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারের বিষয়টি এবার বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রচারণা মনিটরিংয়ে বেশ কিছু নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে। আচরণ বিধিমালায় নির্বাচনী প্রচার মনিটরিং করতে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। মনিটরিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবে।