সম্প্রতি দুই পরিবারের সম্মতিতে ইডেন কলেজের এক ছাত্রীর সঙ্গে রাগিব আহসান নামের এক যুবকের বিয়ে ঠিক হয়। এনগেজমেন্টের দিন-তারিখ নির্ধারিত ছিল ২৬ জানুয়ারি। এরই মধ্যে ছেলেটি ওই তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। একপর্যায়ে তরুণী ওই যুবকের ঘনিষ্ঠ হয়।
বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা আর শপিংয়ের সময় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ছেলেটি তার মোবাইলে ধারণ করে। হবু স্বামীর সঙ্গে ছবি তুলতে তখন আপত্তি করেনি ওই তরুণী। কিন্তু এই ছবিই যে একসময় কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানত? রাগিব আহসান অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ওই ছবিগুলো ফেসবুক ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে তরুণীটির পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। এত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তরুণীর পরিবারের সদস্যদের ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে রাগিব।
টাকা না পেয়ে শেষমেশ ওই ছবি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দেয়। লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে ওই তরুণী দু’দফা আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। বিষয়টি বন্ধু-বান্ধবীরা জেনে যাওয়ায় লেখাপড়াও বন্ধ করে দেয় তরুণী। এখন এক প্রকার স্বেচ্ছাবন্দি জীবনযাপন করছে সে।
শুধু ইডেন কলেজের ওই ছাত্রী নয়, সাইবার অপরাধীদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরী তরুণীরা। কিশোরী ও তরুণীদের ছবি সংগ্রহের পর নগ্ন দৃশ্যের সঙ্গে সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে অশ্লীল স্থিরচিত্র ও ভিডিও তৈরি করে তা দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে অপরাধী চক্র। যারা অর্থের জোগান দিতে পারছে না তাদের ছবি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে পর্নো সাইট, ফেসবুক বা ইউটিউবে। প্রযুক্তির সুবাদে মুহূর্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এসব দৃশ্য।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার সেল ফোনের লক খুলতে যায় ইস্টার্ন প্লাজায় একটি দোকানে। ওই দোকানের কর্মচারী ছাত্রীর সেল ফোনের লক খুলে দেয়। তবে ওই সেল ফোনে থাকা ছাত্রীর দুটি ছবি ব্লুটুথ দিয়ে ডাউনলোড করে নেয় সে। ছাত্রীর অজান্তেই সে এ কাজটি করে। এরপরই ওই ছাত্রীর মোবাইলে ফোন করে তাকে ভালো লাগার কথা জানায় ওই কর্মচারী। একপর্যায়ে প্রস্তাব দেয় প্রেমেরও। রাজি না হওয়ায় ছাত্রীর মুখাবয়বের সঙ্গে নগ্ন দেহের ছবি মিলিয়ে ফোন নম্বরসহ ছেড়ে দেয়া হয় পর্নো সাইটে। প্রতিদিনই এ ধরনের অভিযোগ জমা পড়ছে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম শাখায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান (অতিরিক্ত কমিশনার) মনিরুল ইসলাম সোমবার বলেন, প্রতিদিন এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এটা রোধের জন্য ব্যক্তিগত সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করার আগে তার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়া উচিত। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ফেসবুকে কেউ কারও ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি আপলোড করলে ওই ফেসবুকের মালিককে শনাক্ত করার প্রযুক্তি গোয়েন্দাদের কাছে আছে। মাঝে মধ্যে এসব প্রতারণার অভিযোগে পুলিশ অনেককে আইনের আওতায়ও এনেছে। তবে পর্নো সাইটের অপরাধীদের শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তি এখনও পুলিশের হাতে আসেনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, প্রতিমাসে গড়ে এ ধরনের দুই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে। কিন্তু অজ্ঞতা আর আইনি দুর্বলতার কারণে আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক গৃহবধূ ডিএমপির সাইবার ক্রাইম শাখায় অভিযোগ করেন, তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে প্রবাস জীবনযাপন করছেন। ছোট ভাই ও তিন বছর বয়সী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তিনি মিরপুরে বসবাস করছেন। তার অভিযোগ, পাশের ফ্ল্যাটে বসবাসরত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক যুবক কিছুদিন আগে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সাড়া না দেয়ায় ওই ছেলে তার মুখাবয়বের সঙ্গে অন্য একজনের নগ্ন দেহের একটি ছবি সুপার ইম্পোজ করে ফোন নম্বরসহ ওয়েবসাইটে ছেড়ে দেয়। একের পর এক অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসার পর তিনি ওয়েবসাইটে ছবি ছাড়ার বিষয়টি জানতে পারেন। এ বিষয়টি প্রবাসে থাকা তার স্বামী জানার পর থেকে পারিবারে অশান্তি লেগেই আছে। স্বামীকে তিনি কিছুতেই বিষয়টি বোঝাতে পারছেন না।
সম্প্রতি আইনজীবী, সাংবাদিক ও নারী চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজনকে ফাঁদে ফেলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে সাইফুল ইসলাম সজীব নামের এক প্রতারক। এর আগেও সজীব সাইবার অপরাধের মাধ্যমে নারী ধর্ষণ ও সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে একাধিকবার গ্রেফতার হয়।
এসব মামলায় একাধিকবার জেল খাটার পর জামিনে বের হয়ে ফের শুরু করে একই ধরনের প্রতারণা। সম্প্রতি তার প্রতারণার টার্গেটে পড়েন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। একপর্যায়ে ওই আইনজীবী আইসিটি অ্যাক্টে সজীবের বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। আইসিটি মামলায় সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষায় মহিলা আইনজীবীকে অশ্লীল মেসেজ ও হুমকি দেয়ার প্রমাণ পেয়ে গ্রেফতার অভিযানে নামেন গোয়েন্দারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম শাখার এক কর্মকর্তা জানান, যেসব ওয়েবসাইটে তরুণীদের নগ্ন ছবি ছাড়া হচ্ছে সেসব ওয়েবসাইটের ঠিকানা ভুয়া। নাম-পরিচয় না থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ওয়েবসাইট বন্ধ করার ক্ষমতাও তাদের নেই। এ ক্ষেত্রে তারা শুধু ওয়েবসাইটটি ‘ব্লকড’ করে দিতে পারেন। বন্ধ করার জন্য বিটিআরসির কাছে ধরনা দিতে হয়। এর আগে এ ধরনের অর্ধশতাধিক ওয়েবসাইট চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করা হয়েছিল। তখন বেশ কিছু সাইটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
চক্রটি আগের ঠিকানা পরিবর্তন করে (লিংক পদ্ধতি) নতুন নামে ওয়েবসাইট খুলে সাইবার ক্রাইম অব্যাহত রেখেছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রতারণা ঠেকাতে এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। তা না হলে দিন দিন সাইবার অপরাধ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।