অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কিভাবে নিশ্চিত করবে, বাংলাদেশের কাছে তা আবার জানতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) কাঠামোর আওতায় মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ ও আইনগুলোর প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। এই অধিবেশনে বাংলাদেশকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ইউপিআরবাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগেই তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিল। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় দেশ দুটির প্রতিনিধিরা তাঁদের প্রত্যাশা পুনর্ব্যক্তও করেছেন। এবার তাঁরা ইউপিআর অধিবেশনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। আগামী সপ্তাহে জেনেভায় এই অধিবেশন বসবে।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আজ সোমবার জেনেভায় ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের ৪৪তম অধিবেশন শুরু হচ্ছে। সূচি অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর সকালের অধিবেশনে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। এর জন্য অগ্রিম প্রশ্ন পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি আন্ত মন্ত্রণালয় প্রতিনিধিদল ইউপিআর অধিবেশনে যোগ দেবে।
বাংলাদেশ তার অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বাস্তব পরিস্থিতিও তুলে ধরবে। অধিবেশনে অন্য রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে মানবাধিকারের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন ও সুপারিশ করার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ সেসব বিষয়ে জবাব দেবে। এ ছাড়া যে সুপারিশগুলো যৌক্তিক মনে করবে, সেগুলো গ্রহণ করবে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইউপিআরকে সামনে রেখে বাংলাদেশ তার মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অঙ্গীকার ও অর্জনগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
বিভিন্ন এনজিও বাংলাদেশের জন্য কিছু বিষয়ে সুপারিশ জমা দিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্তত আটটি দেশ বাংলাদেশের জন্য আগাম প্রশ্ন পাঠিয়েছে।
২০১৮ সালেও ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সে সময়ও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছিল। এবারও বাংলাদেশ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অঙ্গীকারবদ্ধ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবে। এ ছাড়া নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নেওয়া উদ্যোগগুলো তুলে ধরবে।
যুক্তরাষ্ট্র যা জানতে চাচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্র পাঁচটি প্রশ্ন বাংলাদেশের সামনে আনছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সক্রিয় নাগরিক সমাজের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্ন থাকবে, বাংলাদেশ সরকার কিভাবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ মানবাধিকারকর্মীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছে ও সুরক্ষা দিচ্ছে?
শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বলেছে, তারা বাংলাদেশের এই অগ্রগতির ধারা অব্যাহত দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র জানতে চাইবে, শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, বিশেষ করে শ্রমিকদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও তাতে যোগ দেওয়ার অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, শরণার্থীরা জীবিকার সুযোগ পেলে তাদের ঝুঁকি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ কমে। আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের জন্যও তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। তাহলে কেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে কাজের সুযোগ দিচ্ছে না?
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, প্রার্থী ও প্রতিবাদকারীদের হয়রানির খবরে উদ্বেগ থাকার কথাও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিশোধের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছাড়াই বাংলাদেশিদের শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশ সরকার কিভাবে নিশ্চিত করছে—জানতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র।
গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশ সরকার বর্ণ, লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে নাগরিকদের সমান অধিকার কিভাবে নিশ্চিত করছে, এটিও জানার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের।
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন যুক্তরাজ্যের
যুক্তরাজ্য জানতে চইবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষ করে গুম, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে বর্তমান ও অতীতের অভিযোগগুলোর বিষয়ে স্বচ্ছতাকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ কী করছে?
বাংলাদেশ সরকার কিভাবে হয়রানি ও অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে—যুক্তরাজ্য তা-ও জানতে চাইবে ইউপিআর অধিবেশনে।
নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং আইনের শাসন, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তুলবে যুক্তরাজ্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে কী কী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, জানতে চাইবে যুক্তরাজ্য।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আরো কী কী উদ্যোগ নিচ্ছে, সে বিষয়েও যুক্তরাজ্যের প্রশ্ন থাকছে।
ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের অঙ্গীকার আমলে নিয়েছে যুক্তরাজ্য। ওই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য জানতে চাইবে, ঝুঁকিতে থাকা জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠী, নারী ও কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী এবং এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) সম্প্রদায়কে সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার কী করছে? বাংলাদেশ এসব বিষয়ে তার অবস্থান জানাবে।
গুমবিষয়ক সনদ নিয়ে বেলজিয়ামেরও প্রশ্ন
জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ বা গুম থেকে সবাইকে সুরক্ষা সনদ, নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ সমর্থন এবং মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা বাতিল করতে বাংলাদেশ উদ্যোগ নেবে কি না, জানতে চাইবে বেলজিয়াম। এ ছাড়া গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ ও অন্যান্য স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারদের সফরের জন্য বাংলাদেশ আমন্ত্রণ জানাবে কি না, তা-ও জানতে চাইবে দেশটি।
এ ছাড়া সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে উদ্যোগ, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বেআইনি বল প্রয়োগের অভিযোগ তদন্ত ও অযৌক্তিকভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রাখবে বেলজিয়াম।
বাল্যবিবাহ বন্ধে আরো উদ্যোগ গ্রহণ, নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ সনদের (সিডও) সংরক্ষিত ধারাগুলো প্রত্যাহারে বাংলাদেশ উদ্যোগ নেবে কি না, সে বিষয়েও বেলজিয়াম জানতে চায়।
মানবাধিকারকর্মীদের বিষয়ে প্রশ্ন জার্মানির
গুম থেকে সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সনদ বাংলাদেশ সমর্থন করবে কি না, অমুসলিমসহ সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা উন্নয়নে বাংলাদেশ কী পরিকল্পনা করছে, তা জানতে চাইবে জার্মানি।
জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারদের সফরের আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না, এটি জার্মানিরও প্রশ্ন। এলজিবিটিআইকিউপ্লাস (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, ইন্টারসেক্সুয়াল, কুইর ও অন্যান্য) ব্যক্তি, মানবাধিকারকর্মী ও তাদের সংগঠনগুলোর সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, তা জানতে চাইবে জার্মানি।
আইন নিয়ে প্রশ্ন সুইডেনের
সাইবার নিরাপত্তা আইন, উপাত্ত সুরক্ষা আইন, বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনের মতো কয়েকটি আইন ও নীতির প্রসঙ্গ তুলবে সুইডেন। আগাম প্রশ্নে ওই দেশটি বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছে, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সংগঠনগুলোর জন্য কাজের উন্মুক্ত পরিবেশ কিভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে? এ ছাড়া ওই আইনগুলো নিয়ে অংশীজনদের উদ্বেগ দূর করতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
বাল্যবিবাহের হার কমাতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগগুলোর বিষয়েও সুইডেন জানতে চাইবে। সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ ও সমাজে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোর বিষয়েও সুইডেন বাংলাদেশের অবস্থান জানবে।
মৃত্যুদণ্ড বিলোপের বিষয়ে জানতে চায় লিখটেনস্টেইন
মৃত্যুদণ্ড বিলোপে বাংলাদেশ উদ্যোগ নেবে কি না, এটিসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে জানতে চাইবে ইউরোপীয় রাষ্ট্র লিখটেনস্টেইন। আগ্রাসনবিষয়ক অপরাধের ক্ষেত্রে রোম সংবিধির কাম্পালা সংশোধনী সমর্থন করতে বাংলাদেশ কী উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে লিখটেনস্টেইন প্রশ্ন করবে বাংলাদেশকে।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে আইসিসির রোম সংবিধিতে কাম্পালা সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে আইসিসির সদস্য দেশে ‘আগ্রাসন’ সংঘটিত হলে তার বিচারিক এখতিয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের ব্যবস্থার বিষয়ে কোড অব কনডাক্টে (কার্যবিধি) বাংলাদেশ যোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কি না, সে বিষয়েও জানতে চাইবে লিখটেনস্টেইন। এ ছাড়া স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অভিবাসী পাচারবিরোধী প্রটোকলে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করবে কি না, তা নিয়েও লিখটেনস্টেইন প্রশ্ন করবে।
এনএমআইআরএফের পক্ষে পর্তুগালের প্রশ্ন
এ বছর প্রথমার্ধে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে মানবাধিকার বিষয়ে উদ্যোগ বাস্তবায়ন, তথ্য তুলে ধরা ও পর্যালোচনায় গঠিত হয় গ্রুপ অব ফ্রেন্ডস অন ন্যাশনাল মেকানিজম ফর ইমপ্লিমেন্টেশন, রিপোর্টিং অ্যান্ড ফলোআপ (এনএমআইআরএফ)।
ওই গ্রুপের পক্ষে পর্তুগাল বাংলাদেশের কাছে জানতে চাইবে, বাংলাদেশ যে সুপারিশগুলো গ্রহণ করছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও প্রভাব পর্যালোচনায় কি কোনো জাতীয় কাঠামো বা প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে? যদি বাংলাদেশের তা থাকে, তাহলে সুপারিশ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জগুলো জানতে চাইবে পর্তুগাল।
বয়সের কারণে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করতে এবং প্রবীণদের মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইবে স্লোভেনিয়া।