ঢাকা ১০:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোদির সফর দিল্লির লাভ নগদে ঢাকার অপেক্ষার পালা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৩৩:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ জুন ২০১৫
  • ৩৬৩ বার

মোদির সফরে ভারতের লাভ নগদে হলেও বাংলাদেশকে সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে। ভারত তার দীর্ঘ দিনের চাওয়া অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেল। সই হওয়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী এ দুই বন্দর ব্যবহার করে নৌ, রেল, সড়ক ও এই তিনটির সমন্বয়ে বহুমাত্রিক পরিবহনব্যবস্থায় (মাল্টি মডেল ট্রান্সপোর্ট) ভারত তার ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসহ অন্যত্র পণ্য পরিবহন করতে পারবে।
কলকাতা-ঢাকা-আগরতলার মধ্যে বাস সার্ভিসের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সরাসরি যাত্রী পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের বেসরকারি কোম্পানি বাংলাদেশে চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যবসাও পেয়েছে।

অন্য দিকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হলে ভারত বাংলাদেশের বন্দরব্যবহার সুবিধা পাবে নাÑ এমন অবস্থান থেকে সরকার সরে এসেছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে তিস্তাচুক্তি সইয়ে অপারগতা প্রকাশ করে ভারত। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে সম্মতিপত্র সই করা থেকে বিরত ছিল বাংলাদেশ। মোদির সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে ভারত। অবশ্য মোদির ঢাকা সফরে দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমানা চুক্তি অনুস্বাক্ষর প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের এ প্রত্যাশাটি পূরণ হওয়ায় সার্বিকভাবে একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি হয়েছে।

মোদির সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি ঢাকা এলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একান্ত বৈঠকে তারা কী আলাপ করেছেন তা অজানা থেকে গেল। কিন্তু যৌথ ঘোষণায় মোদি তিস্তার সাথে ফেনী নদীর পানিবণ্টনকে জুড়ে দিয়েছেন। এ ঘোষণায় শেখ হাসিনা ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতার আলোকেই তিস্তার অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের জন্য মোদিকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারতের সহযোগিতায় যৌথভাবে পদ্মা নদীর ওপর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মোদি শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার আশ্বাসই দিয়েছেন।

মোদির সফরে ভারত যে ২০০ কোটি ডলারের ঋণ ঘোষণা করেছে তাতে মূলত সড়ক, রেলওয়ে, অভ্যন্তরীণ নৌপথ ও বন্দরসংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার লক্ষ্যের কথা যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট অবকাঠামোই গড়ে তুলবে। এই ঋণের আওতায় যেসব গণপরিবহন আনা হবে তাও ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেই কিনতে হবে।

এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী তৌহিদ হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, মোদির সফর সার্বিকভাবে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ সফরেই সবকিছু হয়ে যাবে সেটা আমরা প্রত্যাশা করি না। বড় কোনো অর্জন এতে আছে, সেটা আমি মনে করি না। ইতিবাচক এই পরিবেশ থেকে আগামী বছরগুলোয় কী ফল পাওয়া যায় সেটাই দেখার বিষয়।

তিনি বলেন, ভারতের দেয়া ২০০ কোটি ডলার ঋণ আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নকাজে ব্যয় হলে ভালো। কিন্তু শর্তাবলি যদি এমন থাকে যে অবকাঠামোর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ইট, বালু, সিমেন্ট ভারত থেকে কিনতে হবে তাহলে এর কোনো মানে হয় না। ভারতের দেয়া আগের ১০০ কোটি ডলার ঋণের কঠিন শর্তাবলির কারণে প্রকল্পের অর্থছাড় কয়েক বছর আটকে ছিল। এ ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিলেই তার সফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে।

মোদির সফরে ভারতীয় দু’টি কোম্পানি বাংলাদেশে বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ পাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে আখ্যায়িত করে তৌহিদ হোসেন বলেন, কোনো শর্ত পূরণ করে এবং কী দামে আমরা ভারতের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারব সেটাই দেখার বিষয়। বিদ্যুতের চাহিদা বাংলাদেশে রয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগও প্রয়োজন। শর্তাবলি ঠিক থাকলে আমরা ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানাব।

বাংলাদেশের হাতে থাকা দরকষাকষির অন্যতম কার্ড ট্রানজিট এখনই ভারতের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হলে সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ঠিক কী বিবেচনায় সরকার এ মুহূর্তে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বলতে পারছি না। তবে মোদির সফরের ঠিক আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পর্দার পেছনেও অনেক আলোচনা চলছে। কূটনীতিতে সব কিছু প্রকাশ্যে হয় না।’ তাই কোনো দিক থেকে নিশ্চয়তা পেয়েই হয়তো সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ট্রানজিট নিয়ে ভারতের চাওয়া পূরণ করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা পূরণ হলোÑ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কম দূরত্বের সহজ পথের সুবিধা ভারত পাক, সমস্যা নেই। তবে এই সুবিধাটি ভোগ করে ভারত যতটুকু লাভবান হবে তার একটি অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত। ভারতের ৫০০ টাকা সাশ্রয় হলে বাংলাদেশ তার থেকে ২০০ টাকা চাইতেই পারে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সাথে বাণিজ্যবাধা দূর করার ক্ষেত্রে মোদির সফরে একটি অগ্রগতি হয়েছে। দুই দেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মধ্যে সহযোগিতাসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। দুই দেশের পণ্যের মান সংক্রান্ত সনদের পারস্পরিক স্বীকৃতির কথা আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছিলাম। যে চেতনা নিয়ে দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমঝোতায় এসেছেন, আমরা আশা করব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তা বাধাগ্রস্ত করবেন না।

প্রধানমন্ত্রী মোদি তিস্তার সাথে ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তিটি জুড়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তৌহিদ হোসেন বলেন, তিস্তা নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশ যে সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল, তাতে স্থির থাকতে পারলে ফেনী নদীর চুক্তি সমস্যা হবে না। কারণ তিস্তার চেয়ে ফেনী নদীর পানিবণ্টন অনেক সহজ।

মোদির সফরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি নাÑ জানতে চাওয়া হলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারকে আমি দোষ দেই না। ভারত তার স্বার্থ দেখবে। আমরা নিজেদের স্বার্থ ঠিকভাবে দেখি কি না সেটাই বিবেচ্য বিষয়। ভারত নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে আমাদের কতটুকু সুযোগসুবিধা দিতে পারে সেটাই দেখা উচিত। আমাদের দিক থেকেও বিষয়টা একইভাবে বিবেচনা করা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, নরেন্দ্র মোদির সফরে নেপাল ও ভুটানের সাথে আঞ্চলিক ট্রানজিটের নিশ্চয়তা পেয়েই সরকার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এবার ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায়ের ব্যাপারটিও পরিষ্কার। ট্রানজিট এখন একমুখী নয়, দ্বিমুখী হবে। তাই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে দেখতে হবে। ভারত বন্দরসহ বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০ কোটি ডলার ঋণও দিচ্ছে।

তিনি বলেন, তিস্তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পাওয়া গেছে। কোনো কারণে এ আশ্বাস পূরণ না হলে বাংলাদেশও ট্রানজিট সুবিধা স্থগিত করে দিতে পারবে। ট্রানজিট সুবিধার বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। তবে সিপিডিসহ বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলাপ করে জানা গেছে এবার সরকার যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমেনা মহসিন বলেন, নরেন্দ্র মোদিকে তার দেশের অভ্যন্তরীণ কূটনীতি দিয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে তিস্তার বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে। এবার ভারতের স্বার্থটাও অনেক বিস্তৃত। তারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের জন্য জাতিসঙ্ঘের সংস্কার চাচ্ছে। আঞ্চলিক নেতৃত্বও হাতে নিতে চাচ্ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

মোদির সফর দিল্লির লাভ নগদে ঢাকার অপেক্ষার পালা

আপডেট টাইম : ০৬:৩৩:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ জুন ২০১৫

মোদির সফরে ভারতের লাভ নগদে হলেও বাংলাদেশকে সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে। ভারত তার দীর্ঘ দিনের চাওয়া অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেল। সই হওয়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী এ দুই বন্দর ব্যবহার করে নৌ, রেল, সড়ক ও এই তিনটির সমন্বয়ে বহুমাত্রিক পরিবহনব্যবস্থায় (মাল্টি মডেল ট্রান্সপোর্ট) ভারত তার ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসহ অন্যত্র পণ্য পরিবহন করতে পারবে।
কলকাতা-ঢাকা-আগরতলার মধ্যে বাস সার্ভিসের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সরাসরি যাত্রী পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের বেসরকারি কোম্পানি বাংলাদেশে চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যবসাও পেয়েছে।

অন্য দিকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হলে ভারত বাংলাদেশের বন্দরব্যবহার সুবিধা পাবে নাÑ এমন অবস্থান থেকে সরকার সরে এসেছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে তিস্তাচুক্তি সইয়ে অপারগতা প্রকাশ করে ভারত। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে সম্মতিপত্র সই করা থেকে বিরত ছিল বাংলাদেশ। মোদির সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে ভারত। অবশ্য মোদির ঢাকা সফরে দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমানা চুক্তি অনুস্বাক্ষর প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের এ প্রত্যাশাটি পূরণ হওয়ায় সার্বিকভাবে একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি হয়েছে।

মোদির সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি ঢাকা এলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একান্ত বৈঠকে তারা কী আলাপ করেছেন তা অজানা থেকে গেল। কিন্তু যৌথ ঘোষণায় মোদি তিস্তার সাথে ফেনী নদীর পানিবণ্টনকে জুড়ে দিয়েছেন। এ ঘোষণায় শেখ হাসিনা ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতার আলোকেই তিস্তার অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের জন্য মোদিকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারতের সহযোগিতায় যৌথভাবে পদ্মা নদীর ওপর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মোদি শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার আশ্বাসই দিয়েছেন।

মোদির সফরে ভারত যে ২০০ কোটি ডলারের ঋণ ঘোষণা করেছে তাতে মূলত সড়ক, রেলওয়ে, অভ্যন্তরীণ নৌপথ ও বন্দরসংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার লক্ষ্যের কথা যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট অবকাঠামোই গড়ে তুলবে। এই ঋণের আওতায় যেসব গণপরিবহন আনা হবে তাও ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেই কিনতে হবে।

এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী তৌহিদ হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, মোদির সফর সার্বিকভাবে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ সফরেই সবকিছু হয়ে যাবে সেটা আমরা প্রত্যাশা করি না। বড় কোনো অর্জন এতে আছে, সেটা আমি মনে করি না। ইতিবাচক এই পরিবেশ থেকে আগামী বছরগুলোয় কী ফল পাওয়া যায় সেটাই দেখার বিষয়।

তিনি বলেন, ভারতের দেয়া ২০০ কোটি ডলার ঋণ আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নকাজে ব্যয় হলে ভালো। কিন্তু শর্তাবলি যদি এমন থাকে যে অবকাঠামোর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ইট, বালু, সিমেন্ট ভারত থেকে কিনতে হবে তাহলে এর কোনো মানে হয় না। ভারতের দেয়া আগের ১০০ কোটি ডলার ঋণের কঠিন শর্তাবলির কারণে প্রকল্পের অর্থছাড় কয়েক বছর আটকে ছিল। এ ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিলেই তার সফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে।

মোদির সফরে ভারতীয় দু’টি কোম্পানি বাংলাদেশে বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ পাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে আখ্যায়িত করে তৌহিদ হোসেন বলেন, কোনো শর্ত পূরণ করে এবং কী দামে আমরা ভারতের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারব সেটাই দেখার বিষয়। বিদ্যুতের চাহিদা বাংলাদেশে রয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগও প্রয়োজন। শর্তাবলি ঠিক থাকলে আমরা ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানাব।

বাংলাদেশের হাতে থাকা দরকষাকষির অন্যতম কার্ড ট্রানজিট এখনই ভারতের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হলে সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ঠিক কী বিবেচনায় সরকার এ মুহূর্তে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বলতে পারছি না। তবে মোদির সফরের ঠিক আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পর্দার পেছনেও অনেক আলোচনা চলছে। কূটনীতিতে সব কিছু প্রকাশ্যে হয় না।’ তাই কোনো দিক থেকে নিশ্চয়তা পেয়েই হয়তো সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ট্রানজিট নিয়ে ভারতের চাওয়া পূরণ করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা পূরণ হলোÑ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কম দূরত্বের সহজ পথের সুবিধা ভারত পাক, সমস্যা নেই। তবে এই সুবিধাটি ভোগ করে ভারত যতটুকু লাভবান হবে তার একটি অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত। ভারতের ৫০০ টাকা সাশ্রয় হলে বাংলাদেশ তার থেকে ২০০ টাকা চাইতেই পারে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সাথে বাণিজ্যবাধা দূর করার ক্ষেত্রে মোদির সফরে একটি অগ্রগতি হয়েছে। দুই দেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মধ্যে সহযোগিতাসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। দুই দেশের পণ্যের মান সংক্রান্ত সনদের পারস্পরিক স্বীকৃতির কথা আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছিলাম। যে চেতনা নিয়ে দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমঝোতায় এসেছেন, আমরা আশা করব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তা বাধাগ্রস্ত করবেন না।

প্রধানমন্ত্রী মোদি তিস্তার সাথে ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তিটি জুড়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তৌহিদ হোসেন বলেন, তিস্তা নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশ যে সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল, তাতে স্থির থাকতে পারলে ফেনী নদীর চুক্তি সমস্যা হবে না। কারণ তিস্তার চেয়ে ফেনী নদীর পানিবণ্টন অনেক সহজ।

মোদির সফরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি নাÑ জানতে চাওয়া হলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারকে আমি দোষ দেই না। ভারত তার স্বার্থ দেখবে। আমরা নিজেদের স্বার্থ ঠিকভাবে দেখি কি না সেটাই বিবেচ্য বিষয়। ভারত নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে আমাদের কতটুকু সুযোগসুবিধা দিতে পারে সেটাই দেখা উচিত। আমাদের দিক থেকেও বিষয়টা একইভাবে বিবেচনা করা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, নরেন্দ্র মোদির সফরে নেপাল ও ভুটানের সাথে আঞ্চলিক ট্রানজিটের নিশ্চয়তা পেয়েই সরকার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এবার ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায়ের ব্যাপারটিও পরিষ্কার। ট্রানজিট এখন একমুখী নয়, দ্বিমুখী হবে। তাই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে দেখতে হবে। ভারত বন্দরসহ বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০ কোটি ডলার ঋণও দিচ্ছে।

তিনি বলেন, তিস্তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পাওয়া গেছে। কোনো কারণে এ আশ্বাস পূরণ না হলে বাংলাদেশও ট্রানজিট সুবিধা স্থগিত করে দিতে পারবে। ট্রানজিট সুবিধার বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। তবে সিপিডিসহ বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলাপ করে জানা গেছে এবার সরকার যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমেনা মহসিন বলেন, নরেন্দ্র মোদিকে তার দেশের অভ্যন্তরীণ কূটনীতি দিয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে তিস্তার বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে। এবার ভারতের স্বার্থটাও অনেক বিস্তৃত। তারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের জন্য জাতিসঙ্ঘের সংস্কার চাচ্ছে। আঞ্চলিক নেতৃত্বও হাতে নিতে চাচ্ছে।