সরকারি গ্যারান্টির সুযোগ নিচ্ছে ব্যাংক, দায় বাড়ছে বিজেএমসির

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) খেলাপিযোগ্য ঋণকে কৃত্রিমভাবে নিয়মিত দেখিয়ে ক্রমাগত সুদচার্জ করে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এতে সরকারি এ সংস্থার কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো নিজেরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারই। কারণ, এসব ঋণের বিপরীতে সরকারি গ্যারান্টি থাকায় শেষমেশ তা সরকারকেই পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে নিয়মিত দেখানোয় এসব ঋণের বিপরীতে কোনো প্রভিশন রাখতে হচ্ছে না, উল্টো সংশ্লিষ্ট ঋণের সুদ আয় খাতে নিয়ে নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে পারছে ব্যাংকগুলো। বিজেএমসি ও নিয়ন্ত্রণাধীন মিলগুলোর নিকট বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ সংক্রান্ত এক আলোচনাসভায় এসব বিষয় উঠে আসে। ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিজেএমসির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাওনা অর্থের বিপরীতে ক্রমাগত সুদচার্জ বন্ধ ও অনারোপিত সুদ মওকুফের অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলো হলোÑ অর্থায়নকারী ব্যাংক, বিজেএমসি এবং নিয়ন্ত্রণাধীন মিলগুলো সভা করে দ্রুত অসমন্বিত ঋণ হিসাব সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ এবং হিসাব সমন্বয় শেষে ব্যাংকগুলোর কাছে বিজেএমসির দায় সুনির্দিষ্ট করে পরিশোধ প্রক্রিয়ায় অনারোপিত সুদ মওকুফের বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহার সভাপতিত্বে ওই সভায় বিজেএমসি, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

শুধু বিজেএমসিই নয়, সরকারি অন্য সংস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো সরকারি গ্যারান্টির সুযোগ নিয়ে তাদের ঋণগুলো বছরের পর বছর নিয়মিত দেখিয়ে সুদচার্জ করে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আসলে ব্যাংকগুলো সরকারি গ্যারান্টির সুযোগ নিচ্ছে। তা না হলে খেলাপিযোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সাহস দেখাত না। এর মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হলেও পরোক্ষভাবে সরকারের দায় বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। কেননা সরকারি গ্যারান্টি থাকায় শেষমেশ এই টাকা সরকারকেই দিতে হবে।

সভায় জানানো হয়, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত বিজেএমসি ও নিয়ন্ত্রণাধীন মিলগুলোর কাছে সুদসহ রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ৬৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অপরদিকে এসব ব্যাংকের কাছে মিলগুলোর পাটপণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ ভর্তুকি বাবদ পাওনা টাকার পরিমাণ প্রায় ৯৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ৬৯২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিজেএমসির উপমহাব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) জিয়াউল হক ভূঞা জানান, বিজেএমসির প্রধান কার্যালয় ও ১৯টি মিলের মধ্যে ১১টি মিলের ব্যাংক ঋণের হিসাব সমন্বয় করে আসল ঋণের পাওনা টাকা সরকার থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। তাই বিজেএমসি প্রধান কার্যালয় ও অপর ৮টি মিলের ব্যাংক ঋণের হিসাব সমন্বয়ে তিনি ব্যাংকগুলোর সহায়তা চান। তিনি বলেন, দ্রুত হিসাবগুলো সমন্বয় করা গেলে ঋণের আসল পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া তিনি প্রাপ্য নগদ ভর্তুকি ব্যাংকগুলো থেকে আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বন্ধ ঘোষিত ছয়টি সরকারি পাটকলের অনুকূলে সোনালী ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ১৬০ কোটি ১০ লাখ টাকা। মিলগুলো হলোÑলতিফ বাওয়ানি জুট মিলস লিমিটেড, করিম জুট মিলস লিমিটেড, জুটো ফাইবার গ্লাস, জাতীয় জুট মিলস লিমিটেড, আলীম জুট মিলস লিমিটেড ও কর্ণফুলী জুট মিলস লিমিটেড। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরভিত্তিক এই ঋণের বকেয়া স্থিতি ছিল ১৫৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১০১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা নিয়মিত রয়েছে। অবশিষ্ট ৫৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা মন্দমানে খেলাপি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক একেএম সেলিম আহমেদ বলেন, শ্রেণিকৃত এসব ঋণ হতে ব্যাংক একদিকে আয় অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদকে উক্ত ঋণের বিপরীতে প্রভিশনি সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া এসব ঋণের তহবিল ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড, যা বর্তমানে ৭.৫%) রয়েছে। এ অবস্থায় বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন মিলগুলোর ঋণ হিসাবের বিপরীতে ক্রমাগত সুদচার্জ করা যুক্তিযুক্ত মর্মে মতপ্রকাশ করেন।

জনতা ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঋণ হিসাব শ্রেণিকরণ (খেলাপি) করা হলেই তো সুদচার্জ বন্ধ হবে না। তখনও অনারোপিত সুদ চার্জ করা হবে। শ্রেণিকরণ করার জন্য আসল টাকা পরিশোধ করতে হবে।

অগ্রণী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক সুস্মিতা মণ্ডল বলেন, বন্ধ পাটকলগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং সরকারি গ্যারান্টি থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণগুলো খেলাপি করা হয়নি। ঋণগুলো ভবিষ্যতে খেলাপি করা হলে ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রভিশন আকারে সংরক্ষণ করতে হবে বিধায় তা ব্যাংকের মুনাফা এবং মূলধনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি বলেন, যেহেতু বিজেএমসি ও নিয়ন্ত্রণাধীন মিলসমূহ বন্ধ, তাই ঋণ হিসাবগুলোর ভবিষ্যৎ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিজেএমসি বা সরকারকেই এ দায় কমবেশি যতটুকু হোক পরিশোধ করতে হবে। সুতরাং দ্রুত ঋণ হিসাবগুলো সমন্বিত হলে তা ব্যাংক ও বিজেএমসি উভয়ের জন্যই ভালো। তিনি আরও বলেন, বিজেএমসি ও এর মিলগুলোর ঋণগুলো ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিংয়ের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে অবিলম্বে খেলাপি করা আবশ্যক। তা ছাড়া অনাদায়ী ঋণগুলো কৃত্রিমভাবে নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শন করা হলে এর বিপরীতে আরোপিত সুদ ব্যাংকের আয় খাতে চলে যাবে। ফলে ভবিষ্যতে সুদ মওকুফের পদক্ষেপ গৃহীত হলে হিসাবায়নে জটিলতা তৈরি হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর