হাওর রতা ডেস্কঃ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঘাট থেকে ছাড়ে নৌকা। কিছুদূর যেতেই বন্ধ হয়ে যায় নৌকার ইঞ্জিন। এই সময়েই দুলতে শুরু করে নৌকাটি। মাঝি ইঞ্জিন চালু করে পুনরায় রওনা করেন।
এক-দুই মিনিট পর আবারও বন্ধ হয়ে যায় ইঞ্চিন। নৌকায় থাকা সবাই মাঝিকে ঘাটে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলে নৌকা ঘোরান তিনি। ঘাটে ফেরার পথেই উল্টে যায় নৌকাটি। এভাবেই পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির বর্ণনা দিয়েছেন নৌকার যাত্রী ঈশিতা।
তিনি বলেন, ‘শুরুতে বুঝতে পারিনি এমন হবে। নৌকায় অধিকাংশই নারী ও শিশু ছিলাম। নৌকা দোলায় সবাই ভগবানকে ডাকা শুরু করি। নিমিষেই সব শেষ হয়ে যায়। নৌকা উল্টে গেলে কেউ কাউকে দেখার সুযোগ পাইনি। শিশুগুলোর মুখ এখনো চোখের সামনে ভাসছে। ’
পঞ্চগড় পাঁচপীর এলাকার রঞ্জিত কুমার রায় বলেন, ‘আমার মা সুমিত্রা রানী বাবাসহ বোদেশ্বরী পীঠ মন্দিরে মহালয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। নৌকা ডুবে আমার মা মারা গেছেন। বাবা সাঁতরে পারে উঠেছেন। এত মৃত্যু দেখে আমি মা হারানোর পরও কাঁদতে ভুলে গেছি। আমাদের পূজার আনন্দ আর থাকল না। ’
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় ২৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় এখনো নিখোঁজ রয়েছে অনেকে।
রবিবার বেলা দেড়টার দিকে উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এ নৌকাডুবি ঘটে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আট শিশু, চার পুরুষ ও ১২ নারী রয়েছে। তাদের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর আটজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ১৬ জনের লাশ নদীর পারে রাখা হয়েছে।
মৃতরা হলো শ্যামলী রানী (১৪), লক্ষ্মী রানী (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫), শোভা রানী (২৭), দীপঙ্কর (৬), পিয়ন্ত (৩), রূপালি ওরফে খুকি রানী (৩৫), প্রমিলা রানী (৫৫), ধনবালা (৬০), সুনিতা রানী (৬০), ফাল্গুনী (৪৫), প্রমিলা দেবী (৭০), জ্যোতিষ চন্দ্র (৫৫), তারা রানী (২৫), সনেকা রানী (৬০), সফলতা রানী (৪০), হাশেম আলী (৭০), বিলাশ চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানী (৩৫), উসশী (৮), তনুশ্রী (৫), শ্রেয়সী (১), প্রিয়ন্তি (৮), বিষ্ণু (৩)। নিহতরা বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। ঘাট থেকে নৌকাটি নদীর পানির গতিতে কিছুদূর যাওয়ার পর দুলতে থাকে। এ সময় মাঝি নৌকাটি ঘাটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে নৌকা ডুবে যায়। নৌকার যাত্রীদের অনেকেই সাঁতরে তীরে ওঠে। তবে নৌকার যাত্রীরা বেশির ভাগ নারী ও শিশু হওয়ায় তারা নদীতে ডুবে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন খবর পেয়ে উদ্ধারকাজে যোগ দেয়।
একই সঙ্গে নৌকাডুবির ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এতে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথৈ আদিত্যকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
দুই স্বজনের অপেক্ষায় নদীর পারে বসা মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার দুজন স্বজনকে এখনো পাওয়া যায়নি। জানি না তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে। উদ্ধারের আশায় বসে আছি। ’
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী নৌকাটিতে ছিল। ছোট নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী তোলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমাদের উদ্ধারকাজ পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী চলেছে। তবে কেউ নিখোঁজ থাকলে তাদের স্বজনদের যোগাযোগের জন্য মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ’
স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনেই নৌকাটি ডুবে যায়। প্রতিটি নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ চড়ে যাচ্ছিল। নৌকাটি মাঝনদীতে যাওয়ার পর দুলতে থাকে। এক পর্যায়ে সরাসরি উল্টে যায়। সবাই নৌকার নিচে চাপা পড়ে। কেউ কেউ সাঁতরে উঠে আসে। শিশু ও নারীরা ডুবে যায়। ’
পুলিশ সদস্য মতিয়ার রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সকাল থেকেই আউলিয়ার ঘাটে দায়িত্ব পালন করছিলাম। নৌকার মাঝিদের অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পারাপারের জন্য আমরা নিষেধ করছিলাম। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। মানুষও কথা শুনছিল না। নৌকা পারে ভেড়ার সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে নৌকায় উঠছিল। তাই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। ’
বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোলেমান আলী বলেন, ‘নিহত প্রতি পরিবারকে সৎকারের জন্য ২০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ’
ফায়ার সার্ভিসের রংপুর বিভাগীয় উপপরিচালক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ছয়টি ইউনিটের কর্মীরা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আমাদের অভিযান চলবে। ’