কষ্টের মাঝে খুশির বন্যা সাফজয়ী রূপনা-ঋতুপর্ণার পরিবারে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাফজয়ী বাংলাদেশ দলের নারী ফুটবলার রূপনা চাকমা (১৯) ও ঋতুপর্ণা চাকমা (২০)। দুজনের পরিবারেই আর্থিক অভাব-অনটন। বাবা নেই দুজনেরই।

এভাবে সর্বশেষ সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশের দলে কৃতিত্ব অর্জনে রাঙামাটির মেয়ে রূপনা ও ঋতুপর্ণার পরিবারে কষ্টে মাঝে এখন হঠাৎ বইছে খুশির বন্যা। তাদের গর্বে গর্বিত গোটা রাঙামাটিবাসী।

গোলবারের নিচে অতন্দ্র প্রহরী রূপনা। হয়েছেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা গোলরক্ষক। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভুয়ো আদমে তাদের দুই চালা টিনের ঘর। নেই দরজা জানালা। এক কক্ষের সেই কুঁড়েঘরে থেকেই রূপনার বিশাল সাফল্য। বাবা নেই। শিশুকালে বাবাকে হারিয়েছেন চিরতরে।

সেই কুঁড়েঘরে থাকেন কালাসোনা চাকমা, তার ছেলে (রূপনার বড়ভাই) অটিল চাকমা, ছেলের বউ রিতা চাকমা আর দুই নাতি-নাতনি। এক কোনায় পাতা আছে ছোট চৌকি। কোনো আসবাবপত্রও নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। একটি বাল্বই জ্বলে সেখানে। সেই ঘরে থাকার জায়গা হয় না রূপনার। থাকেন অন্য কারও বাড়িতে। মা কালাসোনা চাকমার এমন আক্ষেপ যেন শেষ হয় না।

প্রায় একই অবস্থা রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের মগাইছড়ি গ্রামের ঋতুপর্ণাদেরও। ঋতুপর্ণারও বাবা নেই। মায়ের কষ্টের সংসারে বেড়ে ওঠা তারও।

১৯ সেপ্টেম্বর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ৩-১ গোলে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সেই দলের দুই সদস্য মিডফিল্ডার ঋতুপর্না চাকমা ও গোলকিপার রূপনা চাকমা।

ঋতুপর্ণা ও রূপনা চাকমার বাড়িতে এখন চলছে আনন্দের উচ্ছ্বাস। এতে উচ্ছ্বসিত নিজেদের গ্রামবাসীসহ এলাকার মানুষ। ঋতু আর রূপনার জন্য সরকারি চাকরির আবেদন জানিয়েছে উভয় পরিবার। তাদের ঘর নির্মাণের জন্য প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাতীয় দলের সদস্য আর ফুটবল ক্যারিয়ার এক হলেও রূপনা আর ঋতু চাকমার জীবনের গল্প আলাদা। দেশ বিদেশে আলো ছড়ানো ঋতুপর্না আর রূপনার বেড়ে ওঠা সাধারণ পাহাড়ি পরিবারে। রূপনার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সঙ্গে। কক্ষের বেড়ায় শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেওয়া রূপনার পুরস্কারের ছবিসহ তার দলের বেশ কিছু বাঁধাই করা গ্রুপ ছবি। পাশেই ঝুলছে বেশ কিছু মেডেল।

রূপনার মা কালাসোনা চাকমা (৬৫) জানালেন, মানুষের কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। তাই কাজ বন্ধ। বাঁ চোখে দেখতে পান না। ছোট ছেলের কুঁড়েঘরেই আশ্রয় তার। চান চিকিৎসা আর একটি বাড়ি। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে রূপনা সবার ছোট। রূপনা চাকমা গাছে চড়তে ওস্তাদ! এজন্য গ্রামের মানুষের কাছে আলাদা কদর রয়েছে তার। উঁচু গাছ থেকে নিমিষেই নারিকেল পেরে দিয়ে পাওয়া ১০-২০ টাকায় তার হাত খরচ হয়ে যায়। বড় তিন ভাই-বোনের বিয়ের পর আলাদা সংসার তাদের।

বড়ভাই শান্তিজীবন আর ভাবি রিতা চাকমার দাবি, রূপনার জন্য একটি সরকারি চাকরি। আরেক ভাই অটিল চাকমা চান গ্রামের সড়ক আর বাড়ির পাশে বড়মহাপুরম নদীর ওপর সেতু।

এরপর কথা হয় ঋতুপর্ণার বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে। টিনের ছাউনি আর বেড়ার তিন কক্ষের বাড়ি তাদের। কক্ষের বেড়ায় শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেওয়া ঋতুর পুরস্কারের ছবিসহ তার দলের বেশ কিছু বাঁধাই করা গ্রুপ ছবি। পাশেই ঝুলছে বেশ কিছু মেডেল। শোকেসের ওপর সাজিয়ে রেখেছে অনেক শিরোপা। খুশির আমেজ বাড়িজুড়েই। প্রতিবেশীরাও যাচ্ছেন যোগ দিতে।

ঋতুর মা ভোজপুতি চাকমা বললেন, শিশু বয়সে ২০১৫ সালে বাবা বরজ বাঁশি চাকমাকে হারিয়েছেন ঋতুপর্ণা। চার বোনের মধ্যে ঋতু চতুর্থ। তারপর তাদের পরিবারে এসেছিল একমাত্র ভাই পার্বন চাকমা। মাত্র ১৮ বছরেই সেও গত ২৯ জুলাই বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা গেছে।

ঋতুর দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দের খবর বাবা আর ভাইকে দিতে না পারলেও খুশি পরিবার, গ্রামবাসী ও দেশের মানুষ। তিন বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন মাকে নিয়েই সংসার ঋতুর। এই খুশির অংশীদার হিসাবে ঋতুর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য একটি সরকারি চাকরির দাবি ঋতুর মা ভোজপুতি আর বোন পুতুলি চাকমার।

ঋতুপর্নাদের গ্রামের মানুষ প্রতিদিনকার প্রয়োজন পূরণ করেন মগাছড়ি ছড়া পার হয়েই। সড়ক নেই। ধানের ক্ষেতের আল ধরে যাতায়াত করতে হয়। গ্রাম থেকে পিচঢালা সড়কে পৌঁছাতে চার কিলোমিটার পাহাড়ি খাল-বন পার হতে হয়। আর রূপনাদের গ্রাম নানিয়ারচরের ঘিলাছড়ি ভুয়ো আদম যেতে বড় মহাপুরম নদীর ওপর বাঁশের সাঁকোতে পার হওয়া গেলেও কোনো সড়ক নেই। পাহারে ঢাল ধরে যেতে হয়। অথচ তাদের অর্জনে এই গ্রামে এখন যাচ্ছেন জেলা প্রশাসকসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।

দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করা নারী ফুটবল দলের হয়ে খেলা ঋতুপর্না আর রূপনা চাকমার জন্যই ওই অজপাড়া গ্রামকে চিনছে সবাই। এজন্য খুশি গ্রামবাসী।

অন্তত ঋতুপর্না আর রূপনার কারণে গ্রামে উন্নয়ন হবে এমন প্রত্যাশা সোনামনি চামা, লক্ষীধন চাকমা, চোইক্যা চাকমাদের। গৃহিণী নীলবানু চাকমা, সুদীপ চাকমা আর চন্দসেন চাকমার প্রত্যাশা- গ্রামের সড়ক, সেতু আর বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা হবে। কাদা পানি মাড়িয়ে হাঁটতে হবে না। গ্রামে যাবে গাড়িও।

পাহাড়ে নারী ফুটবলের আতুরঘর রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়। যেখানে ফুটবল দুনিয়ায় হাতেখড়ি হয়েছে পাহাড়ের সন্তান জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় মনিকা, আনাই, আনুচিং, ঋতুপর্না ও রূপনা চাকমার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য অর্জনে গর্বিত বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান।

রূপনা চাকমার বাড়ি দ্রুত তৈরি করে দিতে বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাঙামাটির জেলা প্রশাসককে। রাঙামাটির পাহাড়ি কন্যাদের এমন সাফল্যের আনন্দে ভাগিদার হতে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান মঙ্গলবারই ঋতুপর্ণা ও রূপনা চাকমার বাড়িতে গেছেন। সেখানে তাদের দুই পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন দেড় লাখ করে তিন লাখ টাকার চেক।

জেলা প্রশাসক বলেন, রূপনা ও ঋতুপর্ণাকে নিয়ে আজ পুরো জাতি গর্বিত। তাদের পরিবারের পাশে আমরা সবাই থাকব। তাদের মায়ের সঙ্গে দেখা করে সম্মান জানাতে পেরে আমি আনন্দ বোধ করছি। তাদের পরিবারের জন্য যা করার, আমরা ভবিষ্যতে সব কিছুই করব।

ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাহাড়ে আরও প্রতিভাবান নারী খেলোয়াড় উঠে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর