হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিভিন্ন সিনেমায় সিরিয়াল কিংবা ওয়েব সিরিজে কিলারের প্রতিচ্ছবি দেখেছেন নিশ্চয়ই! এর মধ্যে অনেক সিনেমা আছে যেগুলো নির্মিত হয়েছে বাস্তবের কোনো সিরিয়াল কিলারের জীবনের উপর ভিত্তি করে। অনেকেই থ্রিলার জনরার এ ধরনের সিনেমা ও গল্প সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন।
সিরিয়াল কিলারদের একেকজনের মধ্যেও আছে রকমফের। কেউ হয়তো ঠান্ডা মাথার খুনি আবার কেউ রাগে বা ক্ষোভে খুনের নেশায় আসক্ত। ঠিক তেমনই এক সিরিয়াল কিলার হলেন চার্লস শোভরাজ। ‘বিকিনি কিলার’ নামেই তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত। বর্তমানে তিনি নেপালের জেলে বন্দি আছে। বয়স ৮০ এর কোঠায়।
সুদর্শন ও শান্ত চেহারার মানুষ চার্লস শোভরাজকে দেখলে কারও আন্দাজ হবে না যে তিনি একজন সিরিয়াল কিলার। তবে কেন তিনি এমন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিলেন? আসলে অনেক অপরাধীর মতো তারও ছিল বিপন্ন শৈশব। ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় শহর সাইগন, যার বর্তমান নাম হো চি মিন সিটি, সেখানে জন্ম চার্লসের।
তার বাবা ছিলেন ভারতীয় ও মা ভিয়েতনামের নাগরিক। ভালোবাসার সম্পর্কে থাকাকালীনই চার্লসের মা গর্ভধারণ করেন। পরে ওই ব্যক্তি চার্লসকে নিজের ছেলে বলে স্বীকৃতি দিতে চাননি। এর মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দু’জনের।
চার্লসের পরে বিয়ে করে ফ্রান্সের এক সেনানায়ককে। তিনি চার্লসকে দত্তক নিতে রাজি হলেও কিশোর চার্লসের মনে মনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে নিজের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে চার্লস। হয়তো ততদিনে তার মনের মধ্যে অপরাধ কর্ম করার ইচ্ছা জাগ্রত হতে শুরু করে।
স্কুলের বোর্ডিং থেকেও দুবার পালিয়েছিল সে। ফ্রান্স থেকে সাইগনে ফিরে যাওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। ধীরে ধীরে ডাকাতি, ড্রাগ কিংবা হিরের চোরাচালানের মতো অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন চার্লস। ১৯ বছর বয়সে প্রথম জেল খাটে সে। তবে তার ব্যবহার মুগ্ধ করেছিল জেলকর্তাদের।
আসলে এটাই ছিল চার্লসের ব্রক্ষ্মাস্ত্র। তার ব্যবহার এতোটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, সবাই তাকে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলত। আর ওই সুযোগটিই কাজে লাগাতেন চার্লস। এরপর জেল থেকে পালিয়ে একের পর এক খুল সংঘটিত করেন তিনি।
সারা জীবনে অসংখ্য খুন করেছে চার্লস। সাত থেকে আটের দশকে ১২-২৪টি খুনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার শিকার হিপি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তরুণ প্রজন্ম। গোয়েন্দাদের হিসাব বলছে, সিয়াটলের এক তরুণীই ছিল চার্লসের প্রথম শিকার। খুন করে যাকে থাইল্যান্ডের এক সমুদ্রখাঁড়িতে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে।
এরপর নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভারতে একের পর এক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকে চার্লস শোভরাজের নাম। এই সিরিয়াল কিলার নানা ভাষা জানতেন। তার ব্যক্তিত্ব যে কাউকে সহজেই আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে সুদর্শন ও স্মার্ট চার্লসকে দেখে নারীরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন।
আসলে ভালো ব্যবহারের আড়ালে শিকার ধরার ফাঁদ পেতে রাখতেন তিনি। তিনি এমনভাবে নারীদের সঙ্গে মিশতেন যে ওই নারীর কোনো সন্দেহই হতো না। তারপর সুযোগ বুঝে ওই নারীদেরকে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করতো। তারপর ধর্ষণ করার পর তাদেরকে খুন করে কেটে পড়তেন চার্লস।
তাকে কেন ‘বিকিনি মার্ডারার’ বলা হয়? আসলে চার্লস টুরিস্ট নারীদেরকে টার্গেট করেই খুন করতেন। তিনি যতগুলো খুন করেছেন বেশিরভাগ মৃত নারীদেরকেই বিকিনি পরা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এ কারণে অনেকেই ধারণা করেন, বিকিনি পরা নারীদের দেখলেই হয়তো তার মাথায় খুনের নেশা চেপে বসতো! তবে এ বিষয়ে চার্লস কোনো মন্তব্য করেননি।
তার খুন করার কৌশল এতোটাই মসৃণ ছিল যে, পরবর্তীতে তার নাম দেওয়া হয় ‘দ্য সারপেন্ট’ অর্থাৎ, সাপ। তিনজনকে ওষুধ খাইয়ে খুনের চেষ্টার অপরাধে চার্লসকে নেওয়া হয় কারাগারে। বিহারের তিহাড় জেলে একটানা ১০ বছর জেল খাটেন তিনি। ১৯৮৬ সালের তার ওই জেলে ১০ বছর পূর্তি হয়।
এই সময় সে জেলের রক্ষীদের জন্য পার্টি দেয়। ততদিনে তার ব্যবহারে মুগ্ধ পুলিশকর্তারাও। ওই সুযোগে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুঁশ করে জেল থেকে পালায় সে। এ যেন সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়। জেল থেকে বারবার পালিয়েছেন তিনি।
সারা জীবনে প্রায় ৩৫ বছরই জেলে কাটিয়েছেন তিনি। আফগানিস্তান, গ্রিসসহ নানা দেশের জেল থেকেই পালিয়েছেন তিনি। একবার তো অ্যাপেনডিক্সের ব্যথার অজুহাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেও পালান এই কিলার।
চার্লসের জীবন নতুন মোড় নেয় ১৯৯৭ সালে। কারাবাসের মেয়াদ শেষ করে ৫২ বছর বয়সীঅ শোভরাজ ভারত থেকে ফিরে যান ফ্রান্সে। তখন রীতিমতো তারকা জীবন কাটাতেই দেখা গিয়েছিল তাকে। সাংবাদিকদের ভিড় লেগেই থাকত তার বাড়িতে। তার এমন চতুরতার কারণে প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হতেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য সংবাদ প্রতিষ্ঠান অর্থও খরচ করতেন।
সবশেষে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৭৫ সালে নেপালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের অপরাধে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এখনো সেখানেই বন্দি এই সিরিয়াল কিলার। এরই মধ্যেই তার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। জেলখানার অন্ধকারেই এখন জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।
চার্লস শোভরাজের জীবনের ভয়াবহতা দেখতে চাইলে নেটফ্লিক্সে তার জীবনের উপর নির্মিত ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সারপেন্টার’ দেখতে পারেন। এছাড়া তাকে নিয়ে ক্রাইম সিনেমা ‘মে অর চার্লস’ ২০১৫ সালে নির্মিত হয়।