জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এক টাকাও ফেরত দেয়নি হলমার্ক গ্রুপ। প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা পরিশোধের শর্তে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার দুই বছর অতিবাহিত হলেও হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম এক টাকাও ফেরত দেননি সোনালী ব্যাংককে। উল্টো এখন জানা যাচ্ছে, তিনি দেশ ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আইনের চোখে ধুলা দিয়ে যে কোনো সময় দেশ ছাড়তে পারেন জেসমিন। অন্যদিকে কাশিমপুর কারাগারে জামাই আদরে রয়েছেন গ্রুপটির এমডি তানভীর মাহমুদ। জেলে বসেই পরিচালনা করছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। জেলে থাকলেও থেমে নেই কোনো কিছুই। প্রতি সপ্তাহে একদিন স্ত্রীর সঙ্গেও একান্তে সময় কাটান তানভীর। জেসমিন ইসলাম ও তানভীর মাহমুদের পারিবারিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, নিজেদের দায় এড়াতে হলমার্কের কারখানার যন্ত্রপাতি বেচে আশুলিয়ায় নতুন কারখানা স্থাপন করেছেন তানভীর মাহমুদের ভাই মাহবুব আলম। এটা একটা কৌশল। ব্যাংক যেন টাকার জন্য চাপ দিতে না পারে, সে কারণে নিজেদের সম্পদ ও কারখানা আত্মীয়স্বজনের কাছে বিক্রির কৌশল নিয়েছেন জেসমিন ও তানভীর। হলমার্কের ছয়টি কারখানা ও গরুর খামার সচল রয়েছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে ন্যূনতম তিন কোটি টাকা লাভ হচ্ছে। অথচ ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করছে না। ২০০৯ সালে কোম্পানির জন্য কেনা প্রায় ২০টি গাড়ি সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন জেসমিন ও হলমার্ক গ্রুপের এক মহাব্যবস্থাপক শামীম আল মামুন। এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে মার্সিডিজ, ল্যান্ড রোভার, র্যাভফোর, রয়্যাল ক্রাউনসহ নামিদামি ব্র্যান্ড।
শুধু তাই নয়, সোনালী ব্যাংককে জানানো হয়েছে, গাড়ি বিক্রির টাকায় নতুন করে আশুলিয়ায় কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করছেন জেসমিন। আর সেই কারখানা থেকে লাভ এলে পাওনা পরিশোধ করা হবে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তানভীরের আগারগাঁও তালতলার বাড়ি ও হলমার্কের করপোরেট অফিস পাহারায় রয়েছে ৩৭ আনসার। আর গাজীপুরের হলমার্ক শিল্পপল্লী পাহারায় রয়েছে ৭২ আনসার। বছরের পর বছর এদের বেতন দিচ্ছে হলমার্ক।
কাশিমপুর কারাগারে বেশ আরাম আয়েশেই রয়েছেন তানভীর। তার রুমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র লাগানো হয়েছে। স্ত্রী জেসমিন ইসলাম প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন তানভীরের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে জেল সুপারের অতিথি কক্ষে তারা একান্তে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার প্রায় প্রতিদিনই সরবরাহ করা হয় তানভীরকে। তবে কাশিমপুর কারাগার-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত বণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তানভীর মাহমুদ একজন সাধারণ কয়েদি। তাকে ৬০ সেলের দোতলায় রাখা হয়েছে। তার পাশের রুমে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নুর হোসেন। তানভীরের কক্ষে এসি লাগানো হয়েছে এমন তথ্য সঠিক নয়। জেলখানায় তাকে কোনো ধরনের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না বলে দাবি করেন তিনি। সূত্র জানায়, তানভীরের ছেলে ফারহান ইসলামের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। জেসমিন ইসলাম তার ছেলেকে নিয়ে লন্ডন পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জেসমিন ইসলামের এক বোন লন্ডন প্রবাসী ২০০৯ সাল থেকে। অপর দুই বোন কানাডা ও ইতালি প্রবাসী। সেক্ষেত্রে জেসমিন ইসলাম একই সঙ্গে কানাডা, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কানাডার নাগরিকত্ব পেতে ইতিমধ্যে তিনি অনেক দূর এগিয়েছেনও। এ জন্য তিনি মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করেছেন। তথ্য গোপন করে কানাডা প্রবাসী হতে সে দেশের সরকারের কাছে জেসমিন ইসলাম ব্যবসায়ী হিসেবে নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন। সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় বারবার নোটিস দেওয়া হলেও সেখানে হাজিরা দেন না জেসমিন। সোনালী ব্যাংক ও দুদকের দায়ের করা ২৬ মামলা চলছে ঢিমেতালে। ফলে ২৬ মামলার জালে পড়ে হলমার্কের কাছ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জেসমিন ইসলাম ছাড়া পাওয়ার আগে হলমার্কের কাছ থেকে ৫২৫ কোটি টাকা পেয়েছে সোনালী ব্যাংক। বাকি ২২৭৬ কোটি টাকা আদায়ে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংকটি। এর মধ্যে মাত্র ২২ কোটি টাকা আদায়ের জন্য হলমার্কের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে তিনটি মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলছে আরও ২৩টি মামলার কার্যক্রম। দুদকের এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে। এসব মামলার সঙ্গে টাকা উদ্ধারের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদালতে মামলা চলছে। দুদকও মামলা করেছে। চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। হলমার্কের ছয়টি কারখানা চালু রয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ বিক্রি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যাংক কিছুই জানে না। মামলা করে টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন শীর্ষ ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, মামলার মাধ্যমে টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে টাকা আদায়ে আদালতে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ নেই সোনালী ব্যাংকের হাতে। জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়ার কারণে সোনালী ব্যাংকের কাছে দলিলাদি নেই। তবে এ মামলা নিষ্পত্তি হলে মাত্র ২২ কোটি টাকা পাবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অথচ সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কের আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, বোর্ডের সিদ্ধান্তে মামলা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রয়ে আরও মামলা করা হবে। সময় দীর্ঘায়িত হলেও মামলার মাধ্যমেই টাকা উদ্ধার করা সম্ভব বলে মনে করে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, এর মাধ্যমে শুধু টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িতই হবে; কিন্তু টাকা তুলতে হলে সমঝোতার মাধ্যমে তুলতে হবে। তিনি বলেন, এটা কোনো ঋণ জালিয়াতি নয়। এটা হচ্ছে স্রেফ একটা প্রতারণা, জালিয়াতি, চুরি। সোনালী ব্যাংক মামলা করলেও আদালতে তথ্য-প্রমাণ দাখিল করতে পারবে না। কেননা এটা কোনো ঋণ নয়। ফলে ব্যাংকের কাছে কোনো দলিলাদিও নেই, যা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবে। এ জন্য মামলা করেও টাকা তুলতে পারবে না।