হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারায় বন্যার পানি পুরোপুরি কমার আগেই ফের বাড়তে শুরু করেছে। মঙ্গলবার (২৮ জুন) রাতের ভারী বৃষ্টির পর থেকে নদীগুলোর কোথাও পানি বাড়ছে আবার কোথাও কমছে। বৃহস্পতিবারও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় সার্বিকভাবে সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের উজানে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, এর ফলে বৃহস্পতিবারের মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
১৫ জুন থেকে উজানের পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সবগুলো উপজেলা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের বড় একটি অংশ। বেশিরভাগ বাসা-বাড়ির খাটের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হয়।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, স্মরণকালের ভয়াবহ ওই বন্যায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনসহ জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। বন্যায় জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। এ পর্যন্ত জেলার ৬১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৪ জন আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রত্যক্ষভাবে গ্রামীণ জনপদের ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবার বিভিন্নভাবে ঘরবাড়ি ভেঙে এবং ফসল নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এ অবস্থায় ওই ভয়াবহ বন্যার পানি গত কয়েকদিনে ধরে ধীর গতিতে নামলেও প্লাবিত রয়েছে বেশিরভাগ এলাকা। ফলে অনেকে এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে দিনাতিপাত করছেন। তবে মঙ্গলবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে মানুষের মাঝে আবারো আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ৬ নদ-নদীর মধ্যে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ৪ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য বলছে, উজানে ভারতীয় অংশে আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও সিকিমে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আগামী দুই-তিন দিন ওই বৃষ্টি চলতে পারে। এতে দেশের প্রধান নদ-নদী সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, (আপার) আত্রাই, ধরলা, দুধকুমার, (আপার) করতোয়া, টাঙ্গন, পুনর্ভবা ও কুলিখের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের অরুণাচলে ১৮৩, চেরাপুঞ্জিতে ৯৩ ও জলপাইগুড়িতে ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দু’এক দিনে অবনতি হয়ে তারপর উন্নতি হতে পারে। আর তিস্তা অববাহিকার বন্যা পরিস্থিতি বেশি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
অন্যদিকে দেশের হাওরপ্রধান জেলা নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে এসব জেলায়ও আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বন্যার পানি বাড়তে পারে। কারণ সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার পানি ওই জেলাগুলোর মধ্য দিয়ে নামতে পারে। সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন সুরমা, বাউলাই, সোমেশ্বরী ও তিতাসের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সিলেট বিভাগের অধিকাংশ, রংপুর, ময়মনসিংহ বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় ও দেশের বাকি এলাকার অনেক স্থানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সকাল থেকে সিলেট নগরের বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথমতে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পয়েন্টে সর্বশেষ ১৫ ঘণ্টায় পানি কমেছে দশমিক ৮ সেন্টিমিটার। একইসময়ে এ নদীর সিলেট সদর পয়েন্টে দশমিক ২ সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে এ পয়েন্টে এখনো বিপৎসীমার দশমিক ৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
সকাল ৯টায় কুশিয়ারা নদীর পানি জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৯৯ ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এই নদীর পানি সর্বশেষ ১৫ ঘণ্টায় দশমিক ১২ সেন্টিমিটার কমেছে। এ নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে। এই পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি কমেছে দশমিক ২ সেন্টিমিটার। তবে লোভাছড়া নদের কানাইঘাট পয়েন্টে বন্যার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।
এছাড়া ধলাই নদীর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ পয়েন্টে ও সারি নদীর জৈন্তাপুর পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৫ ঘণ্টায় ধলাই নদীর পানি বেড়েছে দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার ও সারী নদীতে দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের নিবার্হী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত সিলেটে সুরমা, ধলাই, পিয়াইন, সারি ও লোভা নদীর তীরবর্তী উপজেলাগুলো থেকে পানি প্রায় নেমে গেছে। কুশিয়ারা তীরবর্তী বন্যাকবলিত দুয়েকটি উপজেলা ছাড়া বাকিগুলো থেকে পানি পুরোপুরি না নামলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল। এরইমাঝে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। সহসাই বৃষ্টিপাত না কমলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির মোড় ঘুরতে পারে। ফের প্লাবিত হতে পারে নিম্নাঞ্চল। সিলেট নগরের একাংশেও বন্যার পানি বাড়তে পারে। ফের বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সিলেটের হাওর অঞ্চলে ফের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।