হাওর বার্তা ডেস্কঃ বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীতে বাড়ছে কলা চাষ। বাংলাদেশ ফল গবেষণা ইন্সিটিটিউট টিস্যূ কালচারের মাধ্যমে জি-৯ নামের উচ্চফলনশীল কলার জাত উদ্ভাবন করে। এই নতুন কলার দিকে নজর চাষিদের। সাধারণ কলার চেয়ে দ্বিগুণ ফলন বেশি হওয়ায় জি-৯ চাষে ঝুঁকছেন রাজশাহীর চাষিরা।
নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, যশোর, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে কলার চাষ হয়ে আসছে। সারা বছর দেশের প্রায় সব অঞ্চলে উঁচু জমিতেই কলা চাষ করা যায়। রাজশাহীতেও ব্যাপকভাবে চাষ শুরু হয়েছে এই কলার।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বছরে তিন মৌসুমে কলার চারা রোপণ করা যায়। প্রথম মৌসুম মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ। দ্বিতীয় মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মধ্য মে। তৃতীয় মৌসুম মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর। উত্তম মৌসুম হলো তৃতীয় মৌসুম। কলা চাষে টিস্যু কালচার একটি উত্তম পদ্ধতি। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত ‘জি-নাইন’কলার চারার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি।
এই কলা দু-এক বিঘায় চাষ হচ্ছে না, বরং জেলায় বর্তমানে দুই হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ কলা চাষ এ অঞ্চলে প্রথম। বছর ঘুরে আসতে না আসতেই বাড়ছে জমির পরিমাণ। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে ২০ হাজার ১০৯ হেক্টর জমি কলা চাষের আওতায় এসেছে। সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র এক হাজার ৯০২ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছিল।
তবে এতো অল্প সময়ে কলার আবাদ বাড়ার কারণ হিসেবে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ফল গবেষণা ইন্সিটিটিউট কর্তৃক টিস্যূ কালচারের মাধ্যমে উদ্ভাবিত কলার জাত হচ্ছে জি-৯। এটি উচ্চ ফলনশীল। সাধারণ কলার চেয়ে এটি প্রায় দ্বিগুণ ফলন দেয়। মোট কলার অর্ধেকের বেশি এই নতুন জাতের কলা। এতে কৃষকেরাও লাভবান হওয়ায় কলার আবাদ বাড়িয়েছে। অপরদিকে, গোদাগাড়ী এলাকায় কয়েকজন উদ্যোক্তা প্রায় দুই থেকে আড়াইশ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কলার আবাদ করছেন। এটিও আকস্মিকভাবে কলার আবাদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হতে পারে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আবাদ ও উৎপাদন সংক্রান্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় ২০১৬-১৭ সালে এক হাজার ৯০২ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ করে উৎপাদন হয়েছিল ৫৮ হাজার ২১৯ মেট্রিক। এসময় হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ৩০ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন। পরের বছর (২০১৭-১৮) ৬৫ হেক্টর জমিতে আবাদ বৃদ্ধি পেয়ে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৬১ হাজার ৭৫৬ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয় ৩১ দশমিক ৪ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ সালে আবাদ হয় এক হাজার ৯৯২ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদন হয় ৬৩ হাজার ৪৯১ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি ফলন হয় ৩১ দশমিক ৮৭ মেট্রিক টন।
তবে ২০১৯-২০ সালে কমে আসে কলার আবাদ ও উৎপাদন। এবছর রাজশাহী জেলায় এক হাজার ৯৬৪ হেক্টর জমিতে আবাদ হয় ৬২ হাজার ৪২৫ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি গড় ফলন আসে ৩১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। পরের বছর (২০২০-২১) উৎপাদন বাড়ে। এবছর এক হাজার ৯৭৩ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৬৪ হাজার ৬২ মেট্রিক টন কলা। হেক্টর প্রতি গড় ফলন আসে ৩২ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন।
এদিকে, চলতি বছরে (২০২১-২২) আকস্মিকভাবে বাড়ে কলার আবাদ ও উৎপাদন। এক বছরের ব্যবধানে রাজশাহী জেলায় ৪৩৭ হেক্টর জমিতে আবাদ বৃদ্ধি পায়। আবাদী জমির উপর ভিত্তি করে এক বছরের ব্যবধানে সাম্ভাব্য মোট উৎপাদন ধরা হয় ৭৮ হাজার ৩২৫ মেট্রিক টন, যা গেলো বছরের চেয়ে ১৪ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন। এবছর সাম্ভাব্য গড় ফলন ধরা হয়েছে ৩২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন কলা। তবে কৃষি সম্প্রসারণ তথ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও বাড়তে পারে কলার উৎপাদন।
কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানায়, রাজশাহী অঞ্চলে ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ হয় পুঠিয়া উপজেলায়। চলতি বছরে এ উপজেলাতে মোট এক হাজার দুই হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। এ উপজেলাতেই বসে রাজশাহীর সবচেয়ে বৃহৎ, সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কলার হাট। কলার আবাদ ও উৎপাদনে পুঠিয়ার পর দূর্গাপুরের অবস্থান। এখানে চলতি বছরে ৫২০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। এছাড়া বাগমারা, পবা, চারঘাট ও বাঘায় দেড় থেকে ২০০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। তবে জেলার তানোর, মোহনপুর, গোদাগাড়ী ও চারঘাটে কলার আবাদ নেই বললেই চলে বলে জানিয়েছে কৃষি দপ্তর।
এবিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক তৌফিকুর রহমান বলেন, আগের চেয়ে বর্তমানে মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে কলা। সম্প্রতি কলা খুব লাভজনক একটি কৃষি ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় বিভিন্ন রাস্তা ও রেল লাইনের পরিত্যক্ত জায়গায় কলার চাষ হচ্ছে। আবার রাজশাহীতে প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে পুকুর খনন। এসব পুকুর খননের পর পাড়ে লাগানো হচ্ছে কলার গাছ। একারণে রাজশাহীতে বাণিজ্যিকভাবে কলার আবাদ হচ্ছে। আর আবাদ বাড়ায় উৎপাদনও বেড়েছে গত পাঁচ বছরের তুলনায়।