হাওর বার্তা ডেস্কঃ বন্যায় প্লাবিত সিলেট ও সুনামগঞ্জের বেশির ভাগ এলাকা। উজানের ঢলে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় পানি ঢুকে করছে সর্বনাশ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। সিলেটে পানিবন্দি লাখো মানুষ। খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। কিন্তু সেখানেও দুর্ভোগ আর দুর্দশায় দিন পার করছেন আশ্রিতরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাবে অর্ধাহার, অনাহারে দিন পার করছে মানুষ। একই অবস্থা হ্ওার বাঁওড়ের সুনামগঞ্জেরও। অপরদিকে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, আরও পাঁচ দিন পানিবন্দি থাকতে হবে সিলেটবাসীকে। ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করা বন্যার পানি নেমে আগের অবস্থায় ফিরবে সিলেট নগরীর চিত্র। গতকাল শনিবার (২১ মে) পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলীর (পুর) দপ্তরের সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে বন্যার পানি কমছে। ফলে সিলেটে আর বন্যা পরিস্থিতি বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
বন্যায় যেখানে যেখানে বাঁধ ভেঙেছে সেখানে আমাদের পক্ষ থেকে আবার নতুন করে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে।’ এদিকে সিলেটে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও বাড়ছে কুশিয়ারার পানি। ফলে নগরসহ আশপাশের এলাকার পানি কিছুটা কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সুরমা, কুশিয়ারা, ধোলাই, পিয়াইন নদ-নদীর পানি আগের থেকে অনেকটাই কমে গেছে। তবে এসব এলাকায় পানি কমলেও জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়ে চলছে।
গতকাল শনিবার (২১ মে) সরেজমিনে সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, যেসব এলাকা, বাসাবাড়ি বা দোকানপাটে পানি প্রবেশ করেছিল, তা ধোয়ামোছা করছেন ভুক্তভোগী জনসাধারণ। তবে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সবাইকে বেগ পেতে হচ্ছে। এদিকে বন্যার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের দুর্ভোগ ও অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও আশার বাণী শুনিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেছেন, দিন দিন আবহাওয়া উন্নতি করছে। তিন-চার দিন আগেও যেখানে কয়েক শ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ মিলিলিটার। তিনি আরও বলেন, আগামী ২৩, ২৪ ও ২৫ মের মধ্যে বৃষ্টির পরিমাণ একেবারেই কমে আসবে। বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। এদিকে, গত ৫ দিন ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকা। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে ঘরে খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি সংকটে মানুষ। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও নাজুক। আশ্রয়কেন্দ্রে অনিশ্চিত বসবাস করছে মানুষ। সুরমা অববাহিকার পর এবার কুশিয়ারা অববাহিকতায় ঢল আঘাত হেনেছে।
এদিকে নগরে পানি কিছুটা কমলেও কমেনি বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীনতা, খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি উপদ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। সিলেটে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ এড়াতে নগর ছাড়তে শুরু করেছেন অনেকে। শুক্র ও গতকাল শনিবার নগরের প্লাবিত এলাকার অনেক বাসিন্দাকে নগর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে দেখা যায়। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবারের মতো শনিবারও সুরমার পানি কমা অব্যাহত আছে। শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের দিনের চাইতে কয়েক সেন্টিমিটার পানি কমেছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি দুই সেন্টিমিটার বেড়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে। সিলেটের ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো মজিবর রহমান বলেন, ‘সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সরকার বন্যার্তদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে।’ অন্যদিকে, উজানে বৃষ্টি-ভাটিতেও বৃষ্টি। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জের।
প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবন্দি লোকজনের আর্তনাদ বাড়ছে। ভেসে গেছে খামারের মাছ ও হাঁস। বোরো, আউশ, ইরি ধানি জমি পানির নীচে। নলকুপ নিমজ্জিত থাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গো-খাদ্যের অভাবে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছেনা হাওরবাসীর। হাওরে খবর নিয়ে জানা গেছে, দিনে মাঝে মাঝে হালকা রোদের দেখা মিললেও মুহূর্তেই কালো হয়ে উঠে আকাশ। নামে অবিরাম বর্ষণ। রাতে নামে বর্ষণের সাথে গর্জন। ভোগান্তি আর আতংক এখন তাদের নিত্য সঙ্গী। একটানা পনের দিন ধরে উজানের ঢলের সাথে লড়াই করে চলছেন বানভাসিরা। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেকেই বাসা বাড়ী ছাড়ছেন। আবার অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। প্রথম দিকে জেলার ৫টি উপজেলা বন্যা কবলিত হলেও এখন সারা জেলায় ঢলের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। দুর্গম উপজেলা শাল্লা বন্যা মুক্ত হলেও গত শুক্রবার রাতেই সেখানে পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে পানি ছুঁই ছুঁই করছে।
বানের পানিতে দু’টি হাঁসের খামার ভেসে গেছে। অনেক চেষ্টার পরও খোঁজ মিলছে না হাঁসের। এদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। দিন দিন জেলার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ। গতকাল শনিবার সকালে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত ২৪ ঘন্টায় ৪৬ মি: মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। দোয়ারা বাজারের পানিবন্দি রেহান বেগম বলেন, বন্যার পানিতে টিউবওয়েল ডুবে গেছে। এখন বন্যার পানি গরম করে কোনো রকমে পান করছি। ছাতক উপজেলার বাসিন্দা সুমাইয়া বেগম বলেন, বন্যার পানি পান করায় গলা চুলকাচ্ছে। বানের পানি আসার পর থেকে ঠিকমতো তিনবেলা খেতে পারছি না।