একইভাবে বিশেষ বর্ধিত সভা করে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তিন পদে দলীয় প্রার্থী ঠিক করা হয়। সেখানে কুমিল্লা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের আপন ছোট ভাই গোলাম সারওয়ারকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে।
মূলত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা গুরুত্ব পাচ্ছে।
বার্তা কঠোর হলেও শেষ পর্যন্ত ছাড়ের আভাস
প্রভাববিহীন নিরপেক্ষ ভোটের মধ্য দিয়ে স্থানীয় নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে চাইছে কেন্দ্র। এ জন্য আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সারথি ও মাঠের ত্যাগী নেতাদের ভোট করার সুযোগ করে দিতে চায় দল। এ কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের আত্মীয়-স্বজনকে প্রার্থী হতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধ উপেক্ষা করা হয়েছে।
তবে কেন্দ্রের এই নির্দেশনা সব প্রার্থীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। মন্ত্রী-এমপিদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় কমিটির পদধারী অনেক নেতার নিকটাত্মীয়রাও ভোটে দাঁড়িয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বলি হবেন অনেক প্রার্থী। কেন্দ্রের বেশির ভাগ নেতাই তাঁদের স্বজনদের ছাড় করিয়ে নেবেন। ফলে কেন্দ্রের নির্দেশ না মানা সত্ত্বেও বেশির ভাগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না-ও নেওয়া হতে পারে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাঁরা আওয়ামী লীগ করেন তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করবেন—এটাই স্বাভাবিক। কারো ওপর কোনো চাপ নেই। যাঁরা আগে নির্বাচন করেছেন তাঁরা এখন কেন নির্বাচন করতে পারবেন না! অবশ্যই করতে পারবেন।’
এদিকে গতকাল বুধবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুই ধরনের বার্তা দিয়েছেন। একদিকে তিনি যেমন কঠোরভাবে নির্দেশ মানার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অন্যদিকে আবার সাধারণ ক্ষমার কথাও উল্লেখ করেছেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। আমাদের দলে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের বিষয়টি আছে। দল যার যার কর্মকাণ্ড বিবেচনায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নিয়ে থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাঁরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন না, তাঁদের ব্যাপারে সময়মতো দল সিদ্ধান্ত নেবে।’
চূড়ান্ত পর্যায়েও কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে, দল থেকে বহিষ্কার করা হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাধারণ ক্ষমা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে দলীয় রণকৌশল, সেটা হতেই পারে। সেটা দলের সভাপতি নিতে পারেন।’
কেন্দ্র চায় ঐক্য, সিদ্ধান্তের জন্য বৈঠকের অপেক্ষা
এত কিছুর পরও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে আত্মীয় প্রার্থীদের সরাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন চলে গেলেও বেশির ভাগ প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। যদিও দল থেকে বলা হচ্ছে, সময় এখনো চলে যায়নি। ভোটের আগের দিনও প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে।
দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানতে কেন্দ্র থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলা হচ্ছে। প্রার্থীরা যে অভিভাবকের ভরসায় ভোট করছেন, কেন্দ্র থেকে সেই অভিভাবকের সঙ্গেই কথা বলা হচ্ছে। তবু অনেকে ভোটের মাঠে থাকতে চাইছেন।
এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনের আলোচনা গুরুত্ব পাবে আওয়ামী লীগের আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে। আগামী মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দলীয় সূত্র বলছে, কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্যকারী প্রার্থীদের বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা করা হবে। দলের সাংগঠনিক পর্যায় থেকে প্রার্থীদের নিয়ে প্রস্তুত করা তালিকাও উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে দল।
প্রকাশ্যে বিভক্তি-বিব্রত স্থানীয় আ. লীগ
প্রথম ধাপে নীলফামারীর ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর ভিড়ে ওই দুই উপজেলায় অনেকটা বিব্রত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। উপজেলা দুটিতে চেয়ারম্যান পদে মাঠে রয়েছেন ১২ জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে আটজনই আওয়ামী লীগ নেতা।
দলের স্থানীয় নেতারা বলছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় প্রকাশ্যে নির্বাচনের মাঠে নামতে পারছেন না অনেকে। ফলে অনেকে অন্তরালে থেকে সমর্থন জানাচ্ছেন পছন্দের প্রার্থীকে। সেটিও প্রকাশ হওয়ায় ভীত অনেকে।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী, মধুপুর ও গোপালপুর উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।
ধনবাড়ী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের আপন খালাতো ভাই হারুনার রশিদ হীরাও ভোট করছেন। এমপি রাজ্জাক তাঁর ভাইকে সমর্থন দিচ্ছেন এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সমপাদক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছেন।
মধুপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী প্রার্থী হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থন পাচ্ছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের সব জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী রয়েছেন। তাই সব জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকা স্বাভাবিক। দল থেকে ভোটে অংশ না নেওয়ার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এটা শুধু মন্ত্রী-এমপিদের আপন ভাই, বোন, ছেলে, বাবা, মা, শ্যালক এমন কাছের আত্মীয়দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অন্য আত্মীয়দের ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশ নেই। তাঁরা তাঁদের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন কুমিল্লা, নীলফামারী ও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি