২০ কেজি লবণে মিলছে এক কেজি চাল

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত কয়েক বছর দেশের বাজারে আয়োডিন লবণের এক কেজি ওজনের একটি প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা। কিন্তু অনেকেই জানেন না, লবণচাষের প্রান্তিক চাষিরা প্রতি কেজি লবণের দাম পান মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা। সে হিসাবে এক কেজি চাল কিনতে ২০ কেজি লবণ বেচতে হচ্ছে চাষিকে। মাঝেমধ্যে লবণের সংকটে বাজারে আগুন ধরলেও চাষিরা দাম পান প্রতি কেজিতে মাত্র সাড়ে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫ টাকা।

সরেজমিনে রোববার ও সোমবার দেখা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রান্তিক চাষিরা মনপ্রতি লবণ বিক্রি করছেন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। তাও আবার সর্বনিু ৪৫ কেজিতে হিসাব করা হয় এক মন। সেখান থেকে লেবার চার্জ ও কমিশন বাবদ খরচ ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এতে এক মন লবণের মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১৪০ টাকা। সে হিসাবে কেজিপ্রতি মূল্য ৩টার একটু বেশি।

লবণসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশে লবণের ঘাটতি না থাকলেও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি অব্যাহত আছে। মিলাররা জানান, ২০১৫ সাল থেকে এর আমদানি বেড়েই চলেছে। প্রতিমাসে ৫০ হাজার টন সোডিয়াম সালফেট আমদানি হচ্ছে। চীন ও ভারত থেকে এসব আমদানি করা হয়। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশীয় লবণশিল্পের। দেশে উৎপাদিত লবণের দরপতন অব্যাহত থাকায় ক্রমেই দেশীয় এ শিল্প হুমকির মুখে ধাবিত হচ্ছে।

এদিকে লবণের দরপতনে দিশেহারা কক্সবাজারে লবণ উৎপাদনে জড়িত লক্ষাধিক প্রান্তিক চাষি। গত বছর থেকে লবণ চাষ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন অনেকেই। প্রান্তিক চাষিরা বলছেন, পরিবারের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে রোদের খরতাপ উপেক্ষা করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লবণ উৎপাদনের কাজ করতে হয়। এরপরও ঠিকমতো ভাত জুটছে না। মহেশখালী কালারমারছড়ার লবণচাষি ইলিয়াছ বলেন, ১ কেজি চালের দাম ৬০ টাকারও বেশি। তাই এক কেজি চাল কিনতে ২০ কেজি লবণ বিক্রি করতে হয়। প্রায় একই কথা বলেছেন মাতারবাড়ীর ওয়াসিম আকরাম, আবদুর রহমানসহ জেলার অর্ধশতাধিক চাষি।

লবণচাষিদের দেওয়া তথ্যমতে, মাঠপর্যায়ে প্রতি মন লবণে ৫ থেকে ৭ কেজি পানি হিসাব করা হয়। এ কারণে ৪০ কেজির জায়গায় ৪৫ থেকে ৪৭ কেজি লবণে এক মন ধরা হয়। লবণ বিক্রি করলেও তা ট্রলার কিংবা গাড়িতে তুলে দিতে হয় তাদের খরচে। এতে প্রতি মনে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয়। এছাড়া সরকারি কোনো সহায়তা না পাওয়ার কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লবণ চাষের জন্য পলিথিন নিতে হয়। এজন্য মনপ্রতি কমিশন দিতে হয় ১৫ থেকে ২৫ টাকা।

লবণ ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান মানিক বলেন, প্রতিদিন লবণের এভাবে দরপতন হলে খরচ পুষিয়ে লাভের মুখ দেখা সম্ভব নয়। বিষয়টি লবণশিল্পের জন্য অশনিসংকেত উল্লেখ করে এ শিল্প বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান তিনি।

কক্সবাজারের নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলা ইসলামপুর লবণ শিল্পনগরীতে অর্ধশতের বেশি মিল রয়েছে। মিল মালিকদের সভাপতি শামসুল ইসলাম আজাদ বলেন, দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ লবণশিল্প রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। শিল্পটি এখন অনেকটাই অভিভাবকহীন। এছাড়া অবৈধভাবে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি অব্যাহত রয়েছে। দেশের কিছু লোভী মিল মালিক রয়েছেন, যারা প্রতিবছর লবণ আমদানির চেষ্টা করেন। আর এর প্রভাব পড়ে লবণের বাজারে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চাষিরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

একই অভিযোগ করলেও লবণের ঘাটতি থাকলে আমদানির পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, গত বছর লবণ উৎপাদনে ২২ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ১৬ লাখ মেট্রিক টনের মতো উৎপাদনে হয়েছে। এ কারণে গত বছর ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানির জন্য রাজি হয়েছিল সরকার। কিন্তু ইসলামপুরের সভাপতিসহ সেখানকার মিল মালিকরা লবণ আমদানির বিরোধিতা করার কারণে তা আর হয়নি।

তবে মাত্র ৩ থেকে ৪ টাকায় লবণ কিনে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও নীতিমালাকে দুষছেন মিলাররা। এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তা না ধরায় বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার জেলা ম্যানেজার (ডিএম) জাফর ইকবাল জানান, অবৈধভাবে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানির বিষয়টি তার জানা নেই। মাঠপর্যায়ে লবণের দরপতন হলেও বাজারে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লবণ বিক্রি ও কখনো দাম না কমানোর বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ বলেন, লবণ শিল্পের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রান্তিক চাষিরা যাতে সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর