ঢাকা ০১:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দলীয় লেজুড়বৃত্তি হলে চিকিৎসা হবে না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫৫:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৬
  • ৪০০ বার

বাংলাদেশে বর্তমানে চিকিৎসা সেবার মান সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই নাজুক বলে মনে করেন দেশের চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) এই সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতির সঙ্গে কথা হয় পূর্বপশ্চিমের। তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। অধ্যাপনা করছেন বারডেম হাসপাতালে। দেশের সাম্প্রতিক চিকিৎসা ও চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন।

একান্ত সাক্ষাৎকারে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য খাত বলতে মৃত্যুহার, বিশুদ্ধ পানি, ইমুনাইজেশন (প্রতিষেধক) তুলনামূলকভাবে ভালো। পুষ্টি অবস্থার একটু সমস্যা আছে, তবে সেটা হয় তো উন্নতি করবে।

‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের আর একটা সেক্টর আছে চিকিৎসা ব্যবস্থা বা মেডিকেয়ার। চিকিৎসার যে ব্যাপারটা, সেটা দুইভাবে হচ্ছে। একটা সরকারিভাবে আর একটা বেসরকারিভাবে। সরকারিভাবে যেটা হচ্ছে সেটাতে অব্যবস্থাপনা প্রচুর। গরীবদের চিকিৎসা পাওয়াটা কঠিন। আর বেসরকারিভাবে যেটা আছে সেটা অতি ব্যয়বহুল।’

ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সরকারের রেগুলেটরি ম্যাকানিজম নেই। বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা সবচেয়ে সমস্যাপূর্ণ। কারণ একমাত্র সরকারি জায়গা ছাড়া কোথাও জরুরি চিকিৎসা পাওয়া যায় না। সুতরাং এক কথায় বলতে গেলে তৃতীয় বিশ্বের যে জায়গাটা সেই জায়গাতে আমাদের পাবলিক হেলথের ব্যাপারটা তুলনামূলক ভালো এবং মেডিকেয়ারের যে ইনফ্রাকট্রাকচার সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে খারাপ না। কিন্তু কোয়লিটি আর মূল্যায়নের ব্যাপারে সমস্যা আছে।

‘চিকিৎসাটা সরকারি খাতে অবহেলিত আর বেসরকারি খাতে অপব্যবহার বা অ্যাবিউজ। দুইটার কোনোটাই সুবিধাজনক না। সরকারি খাত অবহেলিত। সেখানে লজিস্টিক সাপোর্ট কম থাকে, চিকিৎসকরা সেইভাবে সহায়তা দেয় না। কিংবা অত্যাধিক রোগী। জনপ্রত্যাশা সেইভাবে পূরণ হয় না ‘

‘অন্যদিকে বেসরকারীখাতে ভালোর সম্ভাবনা অনেক কম। এবং বেশিরভাগ বেসরকারী খাতে কোন কাঠামো নেই। এখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকজন গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসে। এবং সেই জায়গাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারটা তুলনামূলক কম । গ্রামে এর অবস্থা আরও করুণ। কারণ সেখানে যে জায়গার ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলো সেখানকার তদারকি খুবই দুর্বল। তার সঙ্গে ওই জায়গায় দ্বিমতের কোন কারণ নেই, যে ওইখানে ওইটা খুব ভালোভাবে আছে। কিন্তু এটার যে দায়িত্ব নেওয়া উচিত, সেটা হলো জনগণকে সচেতন হতে হবে তাদের দাবি আদায়ের জন্য বা দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাদের অধিকারের জন্য নতুবা সরকারের আইন কানুনের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থার করতে হবে যাতে চিকিৎসার উন্নতি করা যায়।

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চিকিৎসকদের বাণিজ্য প্রসঙ্গে ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন- চিকিৎসক নয়, চিকিৎসাটাই বাণিজ্য হয়ে গেছে। চিকিৎসকতো একটা সহায়ক মাত্র। এখন বাণিজ্যকরণ যে ব্যাপারটা, আজ থেকে ৫০ বছর আগে যেটা ছিল সেটা এখন নাই । এটা বিশ্বায়নের যুগ বা গ্লোবাল। এখন চিকিৎসক নয়, চিকিৎসাটাই বানিজ্যিকরণ হয়ে গেছে। এর জন্য ব্যক্তি দায়ী নয়। এর পুরোটাই যদি সরকারী তদারকির মাধ্যমে হতো তাহলে এটা বাণিজ্যকরণ হতো না। সরকারের ব্যর্থতা আছে, সে দিতে পারে না। কিছু লোকের উদ্বৃত্ত অর্থ আছে সে ফাস্ট ট্রাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা কিনতে চাই। এবং চিকিৎসকরা লোভ লালসার উর্দ্ধে না। সবকিছু মিলে ওই জায়গায় চলে গেছে।

‘চিকিৎসকরা যে অনৈতিক কাজ করে না তা আমি বলতে পারি না। চিকিৎসকরা অনৈতিক কাজ করে। সেটা দেখার বা তদারকির করার দায়িত্ব যাদের তারা দেখে না। সরকারের যে দেখার জায়গাটা সেটাও নাই। কারণ সুশাসনের বিকল্প তো এগুলো কিছু নাই। সুশাসন সমবসময় রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে তবে সুশাসন পাবে না। কারণ এগুলো খালি পড়ে আছে। যে যার মতো তৈরি করছে।’

‘একদিকে রোগ শনাক্ত করতে পারছেন না, আবার রোগিও ছাড়ছেন না, বা উপযুক্ত চিকিৎসা বা চিকিৎসকের সন্ধানও দিচ্ছেন না্। যে যার মতো চিকিৎসা দিচ্ছেন। মাঝখানে রোগিদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কাড়ি কাড়ি টাকা যাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে’- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, একই রোগের কারণে একই চিকিৎসা হওয়ার কথা- এর কোন দ্বিমত নেই। তাহলে একই রোগ কিনা তা প্রথম জানা দরকার। জনগণ যে প্রত্যাশা নিয়ে যায় সেই প্রত্যাশা জনগণের কিছু বোঝার ব্যাপার আছে। সেই বোঝাটা হচ্ছে রোগটা একরকম কিনা।

‘রোগ যদি একটাই হয় তবে সব চিকিৎসকের চিকিৎসা একই হয়। চিকিৎসা নির্ভর করে রোগ ও রোগীর ওপরে। রোগ আর রোগী দুইটা ভিন্ন। কারণ রোগীর মানষিকতা, রোগীর চিন্তাচেতনা, রোগীর সামাজিক ফ্রেম এক না। সুতরাং ওই ফ্রেমে কিছুটা বিচ্যুতি হতে পারে। একই রোগের চিকিৎসা এক কিন্তু রোগী অনুপাতে কিছুটা আলাদা হতে পারে। সেটা চিকিৎসা ভিন্ন নয়। ওটা রোগীর রোগ অনুপাতে হতে পারে।’

একজন রাজনীতিক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, আবার তিনি ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রও বটে, এতে কি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন ঘটতে পারে, বা ঘটছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী (বর্তমান) এই খাতের জন্য ভালো। আমি মনে করি ইচ্ছাটাই মূল ব্যাপার । উনি যদি চান তবে অবশ্যই উন্নতি করতে পারবেন। আর যদি যোগ্য না মনে করেন তবে পদত্যাগ করবেন।

‘সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্যখাতে এই মুহুর্তে সমস্যা কম। এই সময়ে আমাদের নতুন কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এটাকে উন্নত করে অত্যাধুনিক করার যে প্রচেষ্টা সেটা করতে হবে।’

চিকিৎসকদের দলীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পেশাজীবি রাজনীতি করতে পারেন, তবে সেটা একসঙ্গে চলে না। চিকিৎসক বা পেশাজীবি হিসাবে তার অধিকার আছে রাজনীতি করার। দলীয় রাজনীতি করে সরকারী চাকরি করা, পেশার মধ্যে রাজনীতি করা অমার্জনীয়।

‘১৯৯১ সালের পর থেকেই রাজনীতি চিকিৎসকদের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ১৯৯৬ সালের পরে আরও বেশি হযেছে। এগুলো খুবই অপ্রত্যাশিত। উপযুক্ত চিকিৎসককে উপযুক্ত জায়গায় পদায়ন করাই দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ভালো। দলীয়করণ করে দলের ফ্রেমে এনে প্রমোশন বা বদলী এটা অনৈতিক। এতে চিকিৎসার মান নিশ্চিত করা কঠিন। দলীয় লেজুড়বৃত্তি যদি মূল হয় তবে আসল কাজ চিকিৎসাটাই তো হবে না।’

এ থেকে উত্তরণের পথ হিসাবে ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, এটা থেকে উত্তরণের কোন যাদুমন্ত্র নেই আমাদের। এর প্রথম কাজ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের। যারা রাষ্ট্র চালায় তাদের মূল দায়িত্ব এটা বন্ধ করা । আর না হয় জনগণকে প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু কেউই এই ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করছে না। কোনো কোনো চিকিৎসক তার লাভের জন্য এগুলো করছে।

দেশের বেসরকারী মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ও বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি কলেজগুলোর মান কাগজে কলমে খুব সাদা। বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) তাদের রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিচ্ছে। কাগজে কলমে এসব বেসরকারী মেডিকেলের কোন খাত নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বেসরকারী মেডিকেল কলেজের মান খুবই কম। এসব হাসপাতালে রোগী থাকে না, ঠিকমতো ক্লাশ হয় না, নিজেদের খাতা নিজেদের শিক্ষকরাই দেখে। এতে অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। যে বিএমডিসির তদারকি করার কথা সেই বিএমডিসি কোন খোঁজ রাখছে না।

‘বর্তমানে রাজধানীতে যে কয়েকটি সরকারী হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোর সেবার মান পর্যাপ্ত নয়। কখনো রোগীর চাপে কখনও লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয় কখনোবা চিকিৎসকরাই সেবা দিতে অবহেলা করছেন।’

‘রাজধানীর বেসরকারী হাসপাতালগুলো এমন যেন যে যত পারছে সে তত কামাচ্ছে।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দলীয় লেজুড়বৃত্তি হলে চিকিৎসা হবে না

আপডেট টাইম : ১২:৫৫:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

বাংলাদেশে বর্তমানে চিকিৎসা সেবার মান সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই নাজুক বলে মনে করেন দেশের চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) এই সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতির সঙ্গে কথা হয় পূর্বপশ্চিমের। তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। অধ্যাপনা করছেন বারডেম হাসপাতালে। দেশের সাম্প্রতিক চিকিৎসা ও চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন।

একান্ত সাক্ষাৎকারে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য খাত বলতে মৃত্যুহার, বিশুদ্ধ পানি, ইমুনাইজেশন (প্রতিষেধক) তুলনামূলকভাবে ভালো। পুষ্টি অবস্থার একটু সমস্যা আছে, তবে সেটা হয় তো উন্নতি করবে।

‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের আর একটা সেক্টর আছে চিকিৎসা ব্যবস্থা বা মেডিকেয়ার। চিকিৎসার যে ব্যাপারটা, সেটা দুইভাবে হচ্ছে। একটা সরকারিভাবে আর একটা বেসরকারিভাবে। সরকারিভাবে যেটা হচ্ছে সেটাতে অব্যবস্থাপনা প্রচুর। গরীবদের চিকিৎসা পাওয়াটা কঠিন। আর বেসরকারিভাবে যেটা আছে সেটা অতি ব্যয়বহুল।’

ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সরকারের রেগুলেটরি ম্যাকানিজম নেই। বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা সবচেয়ে সমস্যাপূর্ণ। কারণ একমাত্র সরকারি জায়গা ছাড়া কোথাও জরুরি চিকিৎসা পাওয়া যায় না। সুতরাং এক কথায় বলতে গেলে তৃতীয় বিশ্বের যে জায়গাটা সেই জায়গাতে আমাদের পাবলিক হেলথের ব্যাপারটা তুলনামূলক ভালো এবং মেডিকেয়ারের যে ইনফ্রাকট্রাকচার সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে খারাপ না। কিন্তু কোয়লিটি আর মূল্যায়নের ব্যাপারে সমস্যা আছে।

‘চিকিৎসাটা সরকারি খাতে অবহেলিত আর বেসরকারি খাতে অপব্যবহার বা অ্যাবিউজ। দুইটার কোনোটাই সুবিধাজনক না। সরকারি খাত অবহেলিত। সেখানে লজিস্টিক সাপোর্ট কম থাকে, চিকিৎসকরা সেইভাবে সহায়তা দেয় না। কিংবা অত্যাধিক রোগী। জনপ্রত্যাশা সেইভাবে পূরণ হয় না ‘

‘অন্যদিকে বেসরকারীখাতে ভালোর সম্ভাবনা অনেক কম। এবং বেশিরভাগ বেসরকারী খাতে কোন কাঠামো নেই। এখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকজন গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসে। এবং সেই জায়গাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারটা তুলনামূলক কম । গ্রামে এর অবস্থা আরও করুণ। কারণ সেখানে যে জায়গার ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলো সেখানকার তদারকি খুবই দুর্বল। তার সঙ্গে ওই জায়গায় দ্বিমতের কোন কারণ নেই, যে ওইখানে ওইটা খুব ভালোভাবে আছে। কিন্তু এটার যে দায়িত্ব নেওয়া উচিত, সেটা হলো জনগণকে সচেতন হতে হবে তাদের দাবি আদায়ের জন্য বা দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাদের অধিকারের জন্য নতুবা সরকারের আইন কানুনের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থার করতে হবে যাতে চিকিৎসার উন্নতি করা যায়।

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চিকিৎসকদের বাণিজ্য প্রসঙ্গে ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন- চিকিৎসক নয়, চিকিৎসাটাই বাণিজ্য হয়ে গেছে। চিকিৎসকতো একটা সহায়ক মাত্র। এখন বাণিজ্যকরণ যে ব্যাপারটা, আজ থেকে ৫০ বছর আগে যেটা ছিল সেটা এখন নাই । এটা বিশ্বায়নের যুগ বা গ্লোবাল। এখন চিকিৎসক নয়, চিকিৎসাটাই বানিজ্যিকরণ হয়ে গেছে। এর জন্য ব্যক্তি দায়ী নয়। এর পুরোটাই যদি সরকারী তদারকির মাধ্যমে হতো তাহলে এটা বাণিজ্যকরণ হতো না। সরকারের ব্যর্থতা আছে, সে দিতে পারে না। কিছু লোকের উদ্বৃত্ত অর্থ আছে সে ফাস্ট ট্রাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা কিনতে চাই। এবং চিকিৎসকরা লোভ লালসার উর্দ্ধে না। সবকিছু মিলে ওই জায়গায় চলে গেছে।

‘চিকিৎসকরা যে অনৈতিক কাজ করে না তা আমি বলতে পারি না। চিকিৎসকরা অনৈতিক কাজ করে। সেটা দেখার বা তদারকির করার দায়িত্ব যাদের তারা দেখে না। সরকারের যে দেখার জায়গাটা সেটাও নাই। কারণ সুশাসনের বিকল্প তো এগুলো কিছু নাই। সুশাসন সমবসময় রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে তবে সুশাসন পাবে না। কারণ এগুলো খালি পড়ে আছে। যে যার মতো তৈরি করছে।’

‘একদিকে রোগ শনাক্ত করতে পারছেন না, আবার রোগিও ছাড়ছেন না, বা উপযুক্ত চিকিৎসা বা চিকিৎসকের সন্ধানও দিচ্ছেন না্। যে যার মতো চিকিৎসা দিচ্ছেন। মাঝখানে রোগিদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কাড়ি কাড়ি টাকা যাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে’- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, একই রোগের কারণে একই চিকিৎসা হওয়ার কথা- এর কোন দ্বিমত নেই। তাহলে একই রোগ কিনা তা প্রথম জানা দরকার। জনগণ যে প্রত্যাশা নিয়ে যায় সেই প্রত্যাশা জনগণের কিছু বোঝার ব্যাপার আছে। সেই বোঝাটা হচ্ছে রোগটা একরকম কিনা।

‘রোগ যদি একটাই হয় তবে সব চিকিৎসকের চিকিৎসা একই হয়। চিকিৎসা নির্ভর করে রোগ ও রোগীর ওপরে। রোগ আর রোগী দুইটা ভিন্ন। কারণ রোগীর মানষিকতা, রোগীর চিন্তাচেতনা, রোগীর সামাজিক ফ্রেম এক না। সুতরাং ওই ফ্রেমে কিছুটা বিচ্যুতি হতে পারে। একই রোগের চিকিৎসা এক কিন্তু রোগী অনুপাতে কিছুটা আলাদা হতে পারে। সেটা চিকিৎসা ভিন্ন নয়। ওটা রোগীর রোগ অনুপাতে হতে পারে।’

একজন রাজনীতিক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, আবার তিনি ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রও বটে, এতে কি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন ঘটতে পারে, বা ঘটছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী (বর্তমান) এই খাতের জন্য ভালো। আমি মনে করি ইচ্ছাটাই মূল ব্যাপার । উনি যদি চান তবে অবশ্যই উন্নতি করতে পারবেন। আর যদি যোগ্য না মনে করেন তবে পদত্যাগ করবেন।

‘সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্যখাতে এই মুহুর্তে সমস্যা কম। এই সময়ে আমাদের নতুন কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এটাকে উন্নত করে অত্যাধুনিক করার যে প্রচেষ্টা সেটা করতে হবে।’

চিকিৎসকদের দলীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পেশাজীবি রাজনীতি করতে পারেন, তবে সেটা একসঙ্গে চলে না। চিকিৎসক বা পেশাজীবি হিসাবে তার অধিকার আছে রাজনীতি করার। দলীয় রাজনীতি করে সরকারী চাকরি করা, পেশার মধ্যে রাজনীতি করা অমার্জনীয়।

‘১৯৯১ সালের পর থেকেই রাজনীতি চিকিৎসকদের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ১৯৯৬ সালের পরে আরও বেশি হযেছে। এগুলো খুবই অপ্রত্যাশিত। উপযুক্ত চিকিৎসককে উপযুক্ত জায়গায় পদায়ন করাই দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ভালো। দলীয়করণ করে দলের ফ্রেমে এনে প্রমোশন বা বদলী এটা অনৈতিক। এতে চিকিৎসার মান নিশ্চিত করা কঠিন। দলীয় লেজুড়বৃত্তি যদি মূল হয় তবে আসল কাজ চিকিৎসাটাই তো হবে না।’

এ থেকে উত্তরণের পথ হিসাবে ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, এটা থেকে উত্তরণের কোন যাদুমন্ত্র নেই আমাদের। এর প্রথম কাজ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের। যারা রাষ্ট্র চালায় তাদের মূল দায়িত্ব এটা বন্ধ করা । আর না হয় জনগণকে প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু কেউই এই ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করছে না। কোনো কোনো চিকিৎসক তার লাভের জন্য এগুলো করছে।

দেশের বেসরকারী মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ও বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি কলেজগুলোর মান কাগজে কলমে খুব সাদা। বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) তাদের রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিচ্ছে। কাগজে কলমে এসব বেসরকারী মেডিকেলের কোন খাত নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বেসরকারী মেডিকেল কলেজের মান খুবই কম। এসব হাসপাতালে রোগী থাকে না, ঠিকমতো ক্লাশ হয় না, নিজেদের খাতা নিজেদের শিক্ষকরাই দেখে। এতে অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। যে বিএমডিসির তদারকি করার কথা সেই বিএমডিসি কোন খোঁজ রাখছে না।

‘বর্তমানে রাজধানীতে যে কয়েকটি সরকারী হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোর সেবার মান পর্যাপ্ত নয়। কখনো রোগীর চাপে কখনও লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয় কখনোবা চিকিৎসকরাই সেবা দিতে অবহেলা করছেন।’

‘রাজধানীর বেসরকারী হাসপাতালগুলো এমন যেন যে যত পারছে সে তত কামাচ্ছে।’