ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আামাদের মুসলিম সমাজের অনেকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সাদৃশ্যের ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞ। এছাড়া অনেক সন্তানে নামকরণের ইসলামী নীতি সম্পর্কেও অজ্ঞ। ফলে তারা নানা বিকৃত ধারা চর্চা করছে। যার স্পষ্ট উদাহারণ হচ্ছে- আমাদের সমাজে একদল মুসলিম পবিত্র কুরআনে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এতটুকু বুঝেই আবেগে সন্তানের নাম রাখা শুরু করেছেন। অথচ শব্দটির অর্থ খুবই খারাপ। যেমন, তুকায্যিবান (মিথ্যাচারিতা), খিনজীর (শুকর), জাহান্নাম (নরক), আযাবুন আলীম (যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি) ইত্যাদি। এটি অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়া সমাজে মফিজ, আবুল বলে একে অপরকে গালি দেয়। অথচ এটি ইসলামী নামের অংশ। এটির অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
অমুসলিম লেখক, সাহিত্যিকগণ কর্তৃক মুসলিম নামের বিকৃতি ও মুসলিম নামকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতাও মুসলিমদেরকে এ ধরনের বর্জনে প্রলুব্ধ করেছে। যেমন- কলকাতা থেকে ছাপানো বাংলা কবিতার বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ পাঠ্যটি সচিত্র।
যেখানে রাম, রমন ও স্বপন নামের হিন্দু বাচ্চাদেরকে স্কুলে গিয়ে মানুষ হচ্ছে আর রহিম, করিম ও বকর টুপিওয়ালা মুসলিম সন্তানরা স্কুলে না গিয়ে আম চুরি করছে, এভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এছাড়া হিন্দু লেখকগণ কর্তৃক বিকৃত বানান অনুশীলনের রীতি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আজকের প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়, ওয়েব মিডিয়া প্রভৃতিতে মুসলিম নামসমূহকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে হেয় করা হচ্ছে। অপরদিকে সূর্য, তূর্য, কান্তা, জ্যোতি, নির্মল প্রভৃতি নামসমূহকে খুব কদর করা হচ্ছে। অভিনয়, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠ প্রভৃকির ক্ষেত্রে এ নামসমূহ অভিজাত হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ফলে সমাজে এসব নামের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হচ্ছে আর মুসলিমগণ এরূপ নাম রাখতে উৎসাহিত হচ্ছে।
মুসলিমগণ তার আদর্শিক পরিচয়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে স্বতন্ত্রভাবে পরিচিত হবে। আর নামের মাধ্যমেও যে আলাদা স্বাতন্ত্র্যবোধ, ভিন্নতা, আলাদ সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রকাশ ঘটে তা মুসলিমদের অনেকেই বুঝছে না। সারা পৃথিবীতে মুসলিমগণ সূচনালগ্ন থেকে একই ধরনের নামের মাধ্যমে স্বতন্ত্রভাবে পরিচিত। যেমন ইন্দোনেশিয়ার বাহাশাভাষী প্রেসিডেন্ট আবদুর রাহমান ওয়াহীদ, মালেভাষী মালয়োশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মুহাম্মদ, দিবেহীভাণী মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম, তাঞ্জানেয়ার সোয়াহিলি ভাষী আলী হাসান মাভেনী এর প্রকৃষ্ট উদাহারণ। কিন্তু স্বতন্ত্র এ আত্মপরিচয়ের অনুভূতিতে শিথিলতা প্রদর্শিত হচ্ছে।
ইংরেজদের দীর্ঘ ২০০ বছরের শাসনে মুসলিমরা তাদের স্বর্ণযুগের আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে এক ধরণের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ধারা তৈরী হয়েছে। যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়েছে। উইলিয়াম হান্টারের ভাষায়, “ব্রিটিশ শাসনে তারা সব ব্যাপারেই জাতি হিসাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে বাঙালী মুসলিমদের যে হীনমন্যতাবোধ এবং গোলামী স্বভাব জন্মলাভ করেছিল পাকিস্তানের ২৪ বছরে তা কাটেনি, বাংলাদেশের ৫০ বছরেও তেমনি তাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। ফলে আমরা আমাদের স্বর্ণোজ্জ¦ল অতীতের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আবার এদেশের মুসলিমদের মধ্যে বিশেষ করে শহুরে মুসলিমদের মধ্যে দ’ধরনের অনুকরণ প্রবণতা লক্ষণীয়। একদল আধুনিক পাশ্চাত্যের ধারায় নিজেদেরকে গড়ে তোলার প্রয়াসে ইংরেজী শব্দে নামকরণের প্রতি খুবই আগ্রহী। অন্যদল নিজেদেরকে প্রকৃত বাঙ্গালী প্রমাণ করার জন্য বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি অতি আগ্রহী হয়ে বাংলা শব্দে হিন্দুদের নামের মত নিজেদের নামকরণ করে থাকেন।
এদেশে মুসলিমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মাবলম্বী থেকেই মুসলিম হয়েছে। ফলে ইসলামী বিশ্বাস বোধের পরও তারা দীর্ঘদিনর অনুশীলিত রেওয়াজ- রুসুম ছাড়তে পারেনি। অথবা ছেড়ে দিলেও পরবর্তীতে আবার সেগুলো তাদের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে। যেমন- মুসলিম পিতা-মাতা সন্তানদের আদর করে বলে বাবু । অথচ এ বাবু শব্দটি আবহমান কাল থেকে হিন্দু সত্তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি শব্দ। তবুও বাবু শব্দটি মহা পছন্দের বলে জাতীয়তারূপ পরিগ্রহ করেছে।
উল্লিখিত বিকৃত, ভুল ও শরী‘আহ্ বিরুদ্ধ বিভিন্ন দিক, যা মুসলিমরা তাদের সন্তানদের নামকরণ ও সম্বোধনে অনুশীলন করছে তা থেকে মুসলিমদের উদ্ধার করা খুবই জরুরী। এ ধারা চলতে থাকলে এক সময় মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতি সত্তাই বিলুপ্ত হবে। এজন্য নিম্নলিখিত দিক সমূহ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে-
মুসলিম পিতা-মাতা ও সন্তানদের ইসলামী ধারায় নামকরণের গুরুত্ব ও পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরণের বিষয় পাঠের অন্তভুক্ত করে স্বীয় জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ সস্পর্কে মুসলিমদের জাগ্রত করা। মুসলিমদের পারস্পরিক সাক্ষাতে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা। সচেতন মুসলিমদের আলাদা মিডিয়া গড়ে তোলা এবং প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াসমূহে যথাসম্ভব মুসলিম জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য চেতনা তুলে ধরা।
শিক্ষিত আলেম-ওলামাদের এ ব্যাপারে ওয়াজ- নসিহত ও বই লেখার প্রচেষ্টা চালানো। রাষ্ট্রীয়ভাবে জন্ম নিবন্ধন ও নাম নিবন্ধনের সময় মুসলিমদের জন্য স্বীয় আত্ম-পরিচয় বহনকানী শরী‘আহ্সম্মত নামের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক সরকারী রেজিস্ট্রেশনের তথা পি.এস.সি রেজিস্টেশনে শুদ্ধ করে এমনকি সংশোধন করে নাম রেজিস্টেশনের ব্যবস্থা করা। ইসলাম নামকরণের যে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিয়েছে তা অনুশীলন না করে মুসলিমগণ অত্যাধুনিক অথবা অতি বাঙ্গালী সাজতে গিয়ে নিজেদের জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যবোধ আজ বিসর্জন করছে। কোন জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য তার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ হারিয়ে ফেলাই যথেষ্ট। বাংলাদেশের মুসলিমগণ সম্ভবত এক্ষেত্রে বেশি ধাবমান। অথচ এদেশেই মুসলিমদের পূর্ব পুরুষগণ ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যেমনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তেমনি ইংরেজদের গোলামী থেকে মুসলিমদের উদ্ধারে এক অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের নজরানা পেশ করেছেন। যা সকল মুসলিমের জন্য অনুপ্রেরণা ও অনুসরণের পাথেয়। বাংলাদেশের মুসলিমরা সে হারানে গৌরব পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাবে, নিজেদের প্রকৃত মুসলিম পরিচয়ের মাধ্যমে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠা করবে, ব্যক্তির নামের মধ্য দিয়েই প্রাথমিকভাবে যা ফুটে উঠবে, যে পরিচয় একজন মুসলিমের জন্য আত্মতৃপ্তির।
মহান আল্লাহ বলেন, তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, লোকদেরকে আল্লাহ্র দিকে আহবান করে ও সৎ আমল করে এবং ঘোষণা করে (নিজের পরিচয়) নিশ্চয়ই আমি মুসলিমদের অন্তর্গত।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর