আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, অর্পিত সম্পত্তির ‘খ’ তফসিল বাতিল করা হলো। এমনভাবে বাতিল করা হলো যেন মনে হয় বিষয়টি কখনোই অর্পিত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আইনে এভাবে স্পষ্ট করে বলা হলেও বাস্তবে ‘খ’ তফসিল বাতিল হয়নি। কারণ এই তফসিলভুক্ত সম্পত্তির দাবিদারদের আবেদনের সময়সীমা দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সর্বশেষ গত ২৮ মার্চ চতুর্থ দফায় তিন মাসের সময় বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধনের আবেদন করা যাবে। আইনে স্পষ্ট করে বলার পরও কার স্বার্থে বারবার সময় বাড়ানো হচ্ছে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হচ্ছে এই সময়সীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে। এর সঙ্গে উপজেলা, জেলা প্রশাসন, এমনকি মন্ত্রণালয়ের লোকজনও জড়িত।
ঘুষের সুযোগ কিভাবে সৃষ্টি হচ্ছে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভূমি অফিসে আবেদন করতে হলে ভূমির মালিকানাসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আবেদনের সঙ্গে দিতে হয়। এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ধরনা দিতে হয়। টাকা ছাড়া ভূমি অফিস থেকে কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায় না। কাগজপত্র সংগ্রহ করে আবেদন করার পর তা যায় তহশিলদারের (ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা) কাছে। সেখান থেকে যায় কানুনগোর কাছে। তিনি কাগজপত্র পরীক্ষা করে যথাযথ মনে করলে তা নেন শুনানির তালিকায়। এই শুনানি করেন এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি)। এরপর নামজারি-সংক্রান্ত কাজে সংশ্লিষ্ট হয় জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়। কাগজপত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপ পেরোতে টাকা খরচ করতে হয়। মালিকানা-সংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিক থাকলেও প্রতিটি ধাপে টাকা দিতে হয়। কাগজপত্র দেওয়ার নামে টাকা নেয় ভূমি অফিসের লোকজন। কাগজপত্র যথাযথ কি না তা দেখতে টাকা নেন তহশিলদাররা। শুনানির তারিখ দিতে টাকা নেন কানুনগোরা। আর একজন এসি ল্যান্ডের কাঁধে দুই-তিনটি উপজেলার দায়িত্বও আছে। ‘কষ্ট’ করে এসি ল্যান্ড শুনানিতে অংশ নেন বলে তাঁর নামেও টাকা সংগ্রহ করা হয়। এসব টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা হয়ে পৌঁছে যায় ঘাটে ঘাটে।
জানা যায়, নানা ঘাটের আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর। কারণ ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ২০১৩’ জারি হয়েছিল ওই দিন। এতে অর্পিত সম্পত্তির ‘খ’ তফসিল বিলুপ্ত করা হয়েছিল। অর্পিত সম্পত্তিকে দুটি তফসিলে ভাগ করা হয়। ‘ক’ তফসিলে রয়েছে যেসব সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেগুলো, যার পরিমাণ এক লাখ ৯২ হাজার একর। ‘খ’ তফসিলের সাত লাখ একর সম্পত্তির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ২০১৩ সালের আইনে ‘খ’ তফসিলকে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বলা হয়েছে, এই তফসিল বাতিল হওয়ার পরও যদি কোনো ব্যক্তির এ-সংক্রান্ত সম্পত্তির স্বত্ব বা স্বার্থ প্রতিষ্ঠার দরকার হয় তাহলে তা প্রচলিত আইনেই করা হবে। অর্থাৎ অর্পিত সম্পত্তি থেকে ‘খ’ তফসিল বাতিল করা হলেও এ-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হবে প্রচলিত আইন-আদালতের মাধ্যমে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করে ‘খ’ তফসিলসংক্রান্ত বিষয়ে সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন মন্ত্রণালয়েরই একাধিক কর্মকর্তা। আইন জারি হওয়ার ৯ মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই প্রথম পরিপত্র জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, “বাতিলকৃত ‘খ’ তফসিলভুক্ত যেসব সম্পত্তির ভোগদখলকারী তাঁদের মালিকানার সমর্থনে এ পরিপত্র জারির এক বছরের মধ্যে বৈধ প্রমাণপত্র বা দলিলাদি উপস্থাপনে ব্যর্থ হবেন, সেসব সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ৯২ ধারা মতে খাস ঘোষণা করতে হবে।”
প্রথম পরিপত্রের মেয়াদ শেষ হয় ১৩ জুলাই ২০১৫ তারিখে। এর ছয় দিন আগেই জারি করা হয় দ্বিতীয় পরিপত্র। সেখানে ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধনের সময় দেওয়া হয় ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা তৃতীয় দফা পরিপত্রে তিন মাস বাড়িয়ে এই সময়সীমা ৩১ মার্চ নির্ধারণ করা হয়। গত ২৮ মার্চ চতুর্থ দফা পরিপত্র জারি করে ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধনের সময়সীমা আগামী ৩০ জুন নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এক বছর সময় বাড়াতে চেয়েছিলেন। আমি সেটা তিন মাস করেছি। মানুষের এ-সংক্রান্ত হয়রানি লাঘবের জন্য এ পরিপত্র জারি করেছি, যেন সংশ্লিষ্টরা কোনো একটা জায়গায় তাঁদের কথা বলতে পারেন। কারণ অনেকেই নির্ধারিত সময়ে তাঁদের সম্পত্তি অবমুক্ত করার আবেদন করতে পারেননি।’ কিন্তু এ পরিপত্রের মাধ্যমেই বেশি করে হয়রানি করা হচ্ছে এবং আইন অনুযায়ী সময় বৃদ্ধির পরিপত্র জারির সুযোগ নেই—এ কথা জানালে ভূমিমন্ত্রী বলেন, এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আইনটি সংশোধন হলে এ-সংক্রান্ত জটিলতার নিরসন হবে। এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে আইন মন্ত্রণালয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইনটি সংশোধনের জন্য ছয় দফা চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন মন্ত্রীরা। সংশোধনীর খসড়া কেবিনেটে গেলেই তাতে বাধা দেন তাঁরা। মন্ত্রীদের বক্তব্য, যেখানে আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে ‘খ’ তফসিলের বিলুপ্ত হলো, সেখানে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির জন্য আইন সংশোধনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁদের আরো অভিযোগ, অর্পিত সম্পত্তির সুরাহা চান না আমলারা। তাঁরা বিষয়টি জিইয়ে রাখতে চান। তাহলে তাঁদের আয়ের পথ সচল থাকবে।
একজন সিনিয়র মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ‘ক’ তফসিল এবং ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির তালিকা পাঠাতে বলা হয়েছিল। তাঁরা কয়েক বছর সময় নিয়ে এই তালিকা করেছেন, যা পরে ভূমি মন্ত্রণালয় গেজেটভুক্ত করেছে। কিন্তু এই তালিকা তৈরি করতেই তাঁরা গড়িমসি করেছেন। এখন গেজেট জারির পর ৪৬ জেলার ডিসি জানাচ্ছেন তাঁদের তালিকা অসম্পূর্ণ। কেন আপনারা অসম্পূর্ণ তালিকা পাঠালেন? এই অন্যায় করার জন্য তাঁদের বিধি অনুযায়ী শাস্তি হওয়া উচিত। আর পরিপত্র জারি করে ‘খ’ তফসিলের বিষয়টি জিইয়ে রাখা হয়েছে, যা বিলুপ্ত করা হয়েছে সংসদে পাস হওয়া আইনের মাধ্যমে।