রেদোয়ান রনি পরিচালিত ‘আইসক্রিম’ ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে ২৯ এপ্রিল । এতে অভিনয় করেছেন ওমর সানি, পারভিন সুলতানা দিতি, নাজিফা তুষি, শরিফুল রাজ, কুমার উদয় প্রমুখ। ছবির নায়িকা নবাগতা নাজিফা তুষি। দুই নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবাগত শরিফুল রাজ ও নবাগত কুমার উদয়।
‘আইসক্রিম’-এর প্রচারণার অংশ হিসেবে এই তিন নতুনকে নিয়ে বুধবার পূর্বপশ্চিমের কার্যালয়ে এসেছিলেন নির্মাতা। ছবির গল্প, চরিত্র ও নানা বিষয়ে তারা কথা বলেছেন। আড্ডায় পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নিপু বড়ুয়া। সঞ্চালনা করেছেন সৈয়দ নূর-ই-আলম।ছবি তুলেছেন দ্বীপময় চৌধুরী ডিউক। জম্পেশ এ আড্ডার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
ছবির নাম আইসক্রিম কেন?
রেদোয়ান রনি: আইসক্রিম একটি প্রতীকী নাম। আইসক্রিমের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। এটি যেমন টেস্টি তেমন ঠাণ্ডা আবার বিভিন্ন ফ্লেভারেরও। আমার ছবিটিও তেমনই। দর্শককে আশ্বস্ত করার জন্যই আইসক্রিম নামটি রাখা হয়েছে।
আইসক্রিমের ফ্লেভার অর্থাৎ ছবিটির গল্প কেমন?
রেদোয়ান রনি: ছবিটি তরুণ প্রজন্মের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে। এটা মূলত একটা জার্নি। সেই জার্নিতে দর্শককে নিবো। দর্শক সেই জার্নি শেষ করা পর ছবিটি নিয়ে অবশ্যই ভাববে। দর্শক এই তিন নায়ক-নায়িকার মধ্যে নিজেদেরকে খুঁজে পাবে।
অভিনয়শিল্পীদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের চলচ্চিত্রে আসার পেছনের গল্পটা কেমন?
নাজিফা: আমি তখন চ্যানেল আইয়ের সেরা আট এর প্রতিযোগী। রনি ভাই ছিলেন সেই প্লাটফর্মের একটি পর্বের ডিরেক্টর। হুমায়ুন আহমেদ স্যারের একটি উপন্যাসের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল তার অধীনে। সেখানেই তিনি আমাকে তার ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারপর আমি ওই প্লাটফর্মের প্রথম রানার আপ হওয়ার পর তিনি আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন তার ছবিতে অভিনয় করবো কিনা। যদি করতে চাই তবে অডিশন দিতে চলে আসতে বললেন। অডিশন দিলাম, নির্বাচিত হলাম। এখন তো ছবির কাজও শেষ। আমি কৃতজ্ঞ তার কাছে, আমাকে ছবির নায়িকা হিসেবে যোগ্য মনে করার জন্য।
রাজ: আমি ২০১০ থেকে মডেলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। রনি ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখাটা হঠাৎ করেই। তিনি আমাকে ছবিতে অভিনয়ের জন্য অডিশন দিতে বলেন। অডিশনে টিকে যাই আমি।
উদয়: ২০০৯ থেকে আমি মডেলিং করছি। বেশ কয়েকটি ফ্যাশন হাউজের মডেল হয়েছি। মাঝে আমি দিল্লিতে চলে গিয়েছিলাম। সেখানেও মডেলিংয়ের কাজ করেছি। বাংলাদেশে ফিরে এসে জানতে পারি রনি ভাই তার ছবির জন্য একজনকে খুঁজছেন। আমি যোগাযোগ করে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হই। আমার স্বপ্ন ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো। রনি ভাইয়ের মাধ্যমে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
নতুন অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে ছবি নির্মাণ একটু ঝুঁকি হয়ে গেল না? যেখানে বড় বড় শিল্পীদের দিয়েই ছবি চলে না হলে…
রেদোয়ান রনি: নতুনদের নিয়ে ছবি নির্মাণ করলে ঝুঁকি থাকে এই বৃত্তের বাইরে থাকতে চেয়েছি আমি। আমার টার্গেট দর্শক আছে। আর সিনেমাটির গল্প যেমন তাতে যে চরিত্র দরকার সে অনুসারেই শিল্পী নির্বাচন করেছি। বাকিটা আমার উপর। আমার নিজের নির্মাণ নিয়ে আত্মবিশ্বাস আছে। আমি জানি দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে কেমন ছবি দেখতে চায়। আশা করছি, দর্শক নিরাশ হবে না।
অনেক শিল্পীই অভিনয়ে আসেন, অতিদ্রুত তারকা হতে চান..আবারও ঝরেও পড়েন…এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
নাজিফা: আমি আসলে অতিদ্রুত তারকা হতে আসিনি। লাক্স-চ্যানেল আই প্লাটফর্মে তিন মাস গ্রুমিং করানো হয়। এসময় শোবিজের জন্য নিজেকে মোটামুটি যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা যায়, কিন্তু সুপারস্টার হওয়া যায় না। এখানেই অনেকেই ভুল করে। আমি এমনটা মনে করি না। আমি প্রথমত অভিনেত্রী হতে এসেছি, তারকা হতে নয়। তারকার বিষয়টা দর্শকের উপর নির্ভর করবে। সেটা আরও বহুদূরের ব্যাপার।
উদয়: তারকা তো সবাই হতে পারে না। তারকা বলতে চোখ বুজঁলে যাকে পাওয়া যায় তিনি হলেন সিনেমার সালমান শাহ, নাটকের আফজাল হোসেন। এর বাইরেও দু’একজন আছেন। কিন্তু তাদের মতো পারফেকশন তো থাকতে হবে, তাই না? যাই হোক তারকা হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হইনি কখনও। অভিনয়টা নিয়মিত করে যেতে চাই।
রাজ: আগে তো অভিনয়ে নিজের ভিতটা শক্ত করি। দর্শকের ভালোবাসা পাই। দর্শক যখন আমাকে তাদের প্রিয় নায়ক মনে করবেন তখন না আমি নিজেকে মনে করতে পারবো, কিছু অন্তত করতে পারছি। এই ভাবনায় তারকা হওয়ার ব্যাপারটি মোটেও নেই।
অভিযোগ আছে রেদোয়ান রনি তার ছবিতে নাকি দেখিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনীর ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে? এই নিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদ চলছে, প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনীর সন্তানদের চাইতে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশি আসে…
রেদোয়ান রনি: কথাটা ঠিক নয়। আমি আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের কোন উপাদানই ছবিতে আনিনি। আমি কেবল তিনটি চরিত্রকে উপলক্ষ করে গল্প সাজিয়েছি। আমি তাদের ছবি মুক্তিপূর্ব এই আলোচনাকে ইতিবাচক হিসেবেই নিচ্ছি। যারা এমন কথা বলছে এবং প্রতিবাদ করছে তাদের উচিত হবে আমার ছবিটি দেখে মন্তব্য করা।
ছবিতে শুটিংয়ের সময় বাইরের দেশের শিল্পীদের দেখা যায় এক অপরের প্রেমে পড়ে যায়… তেমন কি আপনাদের বেলায় হয়েছে?
রাজ: হয়েছে। আমি পছন্দ করে ফেলেছিলাম নাজিফাকে কিন্তু বাধ সাধে উদয়। সেও নাকি তাকে পছন্দ করে। আমার ও উদয়ের মধ্যে এ নিয়ে দূরত্বও তৈরি হয়েছিল। পরে সেটার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়। আসলে এই পুরো বক্তব্যটি ছবির গল্পের একটা অংশ হা হা হা।
উদয়: আসলে আমাদের সবার সঙ্গে সবার প্রেম ছিল। এই ছবির শুটিংয়ের জন্য অনেকদিন কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন থাকতে হয়েছিল। একটানা কাজের ফলে প্রডাকশন বয় থেকে শুরু করে পরিচালক পর্যন্ত সবাই আমরা আত্মার আত্মীয় হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে নায়িকার দিকে তখনই মনোযোগ ছিল যখন শুটিংয়ের সংলাপ বলেছিলাম তাকে লক্ষ্য করে।
নাজিফা: আমিও উদয়ের কথাই বলবো। নায়ক, ডিরেক্টর অন্যদের আমরা ঘনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে নিয়েছি। কখনো মনে হয়নি এরা আলাদা কেউ। রসায়ন ছিল সবার মধ্যে তবে সেটা কাজের জন্য।
শুটিংয়ের মজা কিংবা অপ্রীতিকর কোন অভিজ্ঞতার কথা বলুন…
রেদোয়ান রনি: অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে এই সিনেমা করতে গিয়ে। এর মধ্যে সাভারে গিয়েছিলাম এই ছবির শুটিং করতে। যে লোকেশনে শুটিং হওয়ার কথা সেখানে গিয়ে দেখি ৭টা মৌমাছির চাক। যেটা এর আগে ছবির রেকি করতে গিয়ে টের পাইনি। পরে যে লোকটি এই চাক বসিয়েছিল তাকে অনুরোধ করে সেই চাকগুলো সরিয়েছি। এজন্য দুদিন শুটিং বন্ধ ছিল। আরেকটি অপ্রীতিকর ঘটনা হচ্ছে, সূর্যাস্তের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করবো। এসময়টা মূলত খুব কম পাওয়া যায়। দুপুর থেকে ক্যামেরা সাজিয়ে বসে আছি। সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে লোকেশনের ঠিক পাশের বাড়িতে আগুন ধরে গেল। সেই বাড়ির লোকজন আবার আমাদের শুটিংয়ে অনেক সহযোগিতা করেছিল। এসময় সূর্যাস্তের দৃশ্য ধারণ করবো নাকি আগুন নেভাতে যাবো, এটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলাম। আগুনে অনেক ক্ষতি হয়েছিল সেই বাড়ির মালিকের। আরেকটি অভিজ্ঞতা ছিল আমার কাছে খুবই ভীতিকর। ওইসময় এক-সপ্তাহ পর পর সেন্টমার্টিনে যাওয়া আসা হতো। সমূদ্রের অবস্থা ভালো না থাকায় এমনটা করতে হয়। এমনই একসময় সেন্টমার্টিন থেকে ফিরছি। কিন্তু আকাশের অবস্থা বলেন আর সমূদ্রের অবস্থা বলেন দুটির অবস্থাই খুবই ভয়াবহ ছিল। কিন্তু আমাদের সেদিন ফিরতেই হতো। কেননা সেদিন মিস করলে এক-সপ্তাহ পর কক্সবাজারে আসতে হতো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন আমরা স্পিড-বোটে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌছাই।
নাজিফা: আমার অভিজ্ঞতাটা রীতিমত বিরক্তিকর। প্রথম যেদিন শুটিংয়ে যাই তার আগের দিন স্থানীয় একটা পার্লারে গিয়ে সেজে আসি। এটা করেছিলাম এজন্য প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছি, পার্লারে গিয়েছিলাম যেন আরও ভালো দেখায়। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে দেখি আমার সারা মুখে ব্রণ উঠে ভরে গেছে। একটু পর শুটিং অথচ আমার এই অবস্থা। নিজের উপর কি পরিমাণ বিরক্ত হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
সিনেমায় অনেক ধরনের সঙ্কট আছে। সঙ্কট নিরসনে কি ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
রেদোয়ান রনি: সিনেমায় সঙ্কটের শেষ নেই। তবে এর মধ্যে থেকে ডিস্ট্রিবিউশন ও হলের পরিবেশ একটা বড় সমস্যা। ঢাকার বাইরে সিনেমা হলগুলোতে পরিবেশ খুবই বাজে। সেখানে পরিবার নিয়ে ছবি দেখা তো দূরে থাক রুচিসম্পন্ন মানুষ একা একা দেখতেই বিব্রত বোধ করেন। ডিস্ট্রিবিউশিন সিস্টেমেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। হল মালিকরা কখনো পরিচালক কিংবা প্রযোজক সিনেমার টিকিট বিক্রির হিসাবটা দেন না। যার কারণে সিনেমা কেমন চললো সেটা বোঝা যায় না। গোপনে পাওয়া রিপোর্ট যদি বলে হল-ভর্তি দর্শক হয়েছে তখন হল রিপোর্ট বলে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকই হয়নি। এর ফলে যেকোনো ছবি ব্যবসায় সফল নয় বলে অভিহিত হয়। এ দুটি সমস্যা সমাধান না হলে একদিকে যেমন দর্শক হলে যাবেন না অন্যদিকে প্রযোজকরাও নতুন সিনেমা নির্মাণে এগিয়ে আসবেন না।
ডিরেক্টর সম্পর্কে বলেন…
রাজ: রনি ভাই শুধু ডিরেক্টরই নন। তিনি একজন শিক্ষকও। রাজের ভেতর থেকে যোগ্য রাজকে বের করে এনেছেন তিনি। যে যোগ্যতার কথা হয়তো আমারও জানা ছিল না।
উদয়: রনি ভাই এমন একজন মানুষ যার সঙ্গে মেন্টালি কানেক্ট করতে পেরেছি খুব সহজেই। নিজে নিজে সংলাপ প্র্যাকটিস করে যেখানে দৃশ্যে আমার চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে কষ্ট হচ্ছিল সেখানে তিনি দেখিয়ে দেয়ার পর খুব সহজে পেরেছি।
নাজিফা: সিনেমার একটা ফিল আছে। সেই ফিলটা কেমন হতে পারে সেটা রনি ভাই খুব ভালো করেই শিখিয়েছেন যেটা এই ছবিতে অভিনয়ের প্রতিটা সময়েই কাজে লেগেছে।
নাজিফা, রাজ ও উদয়কে নিয়ে বলুন…
রেদোয়ান রনি: ওদের তিনজনেরই এটা প্রথম ছবি। ওরা কেমন করেছে সেটা দর্শক বিচার করবে। আমি যেটা বলবো নতুন হিসেবে ওরা ওদের সর্বোচ্চ সামর্থ্যটাই দিয়েছে আমার এই ছবির জন্য। আমি যেমন চেয়েছি তেমনটাই দিতে চেষ্টা করেছে এই তিনজন। ওরা না থাকলে আমার ছবিটাই বানাতে পারতাম না।