৫জি চালু বাংলাদেশে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ টুজি’র (দ্বিতীয় প্রজন্ম), থ্রিজি (তৃতীয় প্রজন্ম), ফোরজিকে ব্যক্তি গ্রাহক পর্যায়ের ডিজিটাল বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ফাইভজিকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বিশ্বের বিভিন্ন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক ও প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ৫জি তথা মোবাইল ব্রডব্যান্ড, আইওটিসহ নানামুখী সেবার বাণিজ্যিক বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে। এজন্য উন্নয়নশীল ও উন্নত বহুদেশ ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক ও পরীক্ষামূলকভাবে ৫জি চালু করেছে।

বাংলাদেশেও টুজি, থ্রিজির পর ফোরজিতে বদলে যায় প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের জীবনযাত্রা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই লেগেছে এর ছোয়া। তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। তথ্য-প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে এবার বাংলাদেশে চালু হচ্ছে ৫জি। আজ রোববার পঞ্চম ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে ফাইভ জি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশ। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে এ ঐতিহাসিক যাত্রার শুভ উদ্বোধন করবেন। এ মাহেন্দ্রক্ষণটি ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছেন, ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের দিনে ৫জি’র যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে সীমিত আকারে টেলিটকের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে এই সেবা চালু করা হচ্ছে। পরবর্তীতে অন্য মুঠোফোন অপারেটরদের জন্য ৫জি তরঙ্গ নিলাম করা হবে। ফলে আগামী বছর অন্যান্য অপারেটরও ৫জি চালু করতে পারবে। অবশ্য খুব দ্রæতই সারা দেশে ৫জি ছড়িয়ে দেওয়া হবে, বিষয়টি তেমন নয়। ৫জি সেবা বেশি কাজে লাগবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায়। সেদিকেই নজর বেশি থাকবে। পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল শিল্পকারখানায় ৫-জি সেবা দেওয়ার জন্য বিটিসিএলকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। মন্ত্রী আরও বলেন, ফাইভ-জি ডিভাইসের সংকটের কথা বলা হচ্ছে। ফাইভ-জি পুরোপুরি চালুর আগেই দেশে ডিভাইস সংকট থাকবে না। এখনই বাংলাদেশে ফাইভ-জি স্মার্টফোন তৈরি হচ্ছে। চাহিদার ৯০ শতাংশ ৪জি স্মার্টফোন এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে।

টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাব উদ্দিন জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত¡ মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমেই রাজধানীর ৬টি স্থানে এই সেবা চালু করা হবে। পঞ্চম প্রজন্মের এই ইন্টারনেট সেবা চালুর জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে টেলিটক। প্রথমদিন ৬টি সাইটে পরীক্ষামূলক চালু হলেও ২০২২ সালের মধ্যে রাজধানীর ২০০টি টাওয়ারে ৫জি সেবা চালু করবে অপারেটরটি।

জানা যায়, এখন যেসব এলাকায় নেটওয়ার্ক আছে সেগুলোর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ৫জি সেবা প্রদানের জন্য টেলিটককে ইতোমধ্যে ২ হাজার ২০৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে ২০২৩ সালে। এছাড়া ৫জি সেবার জন্য অপারেটরটিকে ইতোমধ্যে স্পেকট্রামও বরাদ্দ দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)।

৬টি সাইটের মধ্যে ৪টিতে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে হুওয়াওয়ে এবং দুইটিতে নোকিয়া। হুওয়াওয়ে বাংলাদেশের চিফ টেকনিক্যাল অফিসার কেভিন স্যু বলেন, ফোর জি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে, ফাইভ জি বদলে দেবে সমাজ এবং সেই যাত্রার অংশ হতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। বাংলাদেশে ফাইভ জি নেটওয়ার্কের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে আমরা টেলিটকের সাথে অংশ নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে আমরা টেলিটকের এই প্রথম ফাইভ জি সাইটগুলির মধ্যে ৬৫ শতাংশেরও বেশি সাইটে আমরা প্রযুক্তি প্রদান করছি। একটি সম্পূর্ণভাবে কানেক্টেড ও ইন্টেলিজেন্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশে হুয়াওয়ে রয়েছে।

মোবাইল ফোনের পঞ্চম জেনারেশন ইন্টারনেটকে সংক্ষেপে বলা হয় ফাইভজি বা ৫জি। ৪জির তুলনায় অনেক দ্রæতগতিতে ইন্টারনেট থেকে তথ্য ডাউনলোড-আপলোড করা যায় এই ৫জি সেবায়। হাই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়ে থাকে ৫জি মোবাইল নেটওয়ার্কে। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে একই সময়ে অনেক মোবাইল ফোনে দ্রæতগতিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। মানুষ ও ডিভাইসের মধ্যে তৈরি হবে জিরো ডিসটেন্স কানেক্টিভিটি। এতে প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি সহজ হয়ে যাবে প্রযুক্তিনির্ভর অনেক কাজ।

বলা হচ্ছে, ৫জি প্রযুক্তি মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা বদলে দেবে। ৫জি প্রযুক্তির মাধ্যমে চালকবিহীন গাড়ি চলবে রাস্তায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আরও শক্তিশালী হবে। স্মার্ট সিটি বিনির্মাণ সহজ হবে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকা রোবট পরিচালনা করা যাবে। বাড়বে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) প্রযুক্তির ব্যবহার। সেন্সরগুলোর ডাটা স্থাপিত হবে ট্রাফিক লাইটে, ঘরে, অফিসে, থানায়, পাবলিক পার্কে। ফলে নগর ব্যবস্থাপনা হবে আরো সহজ।

এছাড়া বিগডাটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে ৫জি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ৫জি চালু হলে আমূল পরিবর্তন আসবে চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে। ৫জি প্রযুক্তির মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবার উন্নয়নের ফলে গ্রামে বা প্রত্যন্ত এলাকায় বসেও রোগী শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবেন। চাইলে বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎকের কাছ থেকেও পরামর্শ নিতে পারবেন। দূর শিক্ষণ বা অনলাইন ক্লাসরুমের ফলে দূরগ্রাম বা প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে। ৫জি ডিজিটাল ডিভাইড বা প্রযুক্তিগত বৈষম্য দূর করতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, ৫জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু হলে দেশের চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে উন্নয়ন ঘটবে, বদলে যাবে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যবসা, মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা। পাওয়া যাবে উন্নত টেলিমেডিসিন সেবা। এতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও সহজেই উন্নত চিকিৎসা সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে। এমনকি দেশের চিকিৎসকের পাশাপাশি বিদেশের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গেও পরামর্শ করা যাবে। ৫জি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস করতে পারবে দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরাও। অর্থাৎ হাতে মুঠোয় চলে আসবে বিশ্বের নামিদামী সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস। এর মাধ্যমে দূর হবে প্রযুক্তিগত বৈষম্য। ৫জি নেটওয়ার্কে গেমিংয়ে কোনো প্রকার ল্যাগ ছাড়াই খেলা যাবে। বাফারিং ছাড়াই অনলাইনে হাই রেজ্যুলেউশন বা ৪০০ ভিডিও দেখা যাবে। একই সঙ্গে ডিস্টার্ব ছাড়াই আরো উন্নত ও স্বচ্ছভাবে ভিডিও কল করা যাবে। এ ছাড়া চালকবিহীন গাড়ি, লাইভ ম্যাপ এবং ট্রাফিক তথ্য জানার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এই ৫জি নেটওয়ার্ক সেবা।

টেলিটকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ রেজাউল করিম রিজভী বলেন, চলতি বছর পরীক্ষামূলক এবং আগামী বছর সীমিত আকারে ৫জি সেবা চালু হলেও এর ইকোসিস্টেম তৈরি হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত লাগবে।
৫জিতে যাওয়ার আগে অবকাঠামো তৈরির কথা জানিয়ে গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান বলেন, ৫জি ব্যক্তির জন্য নয়, এটি হবে সমাজের জন্য। এর ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সব সেবা চলে যাবে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে শিল্প-গার্মেন্টস শিল্পের মতো শিল্প কারাখানায়। এজন্য ইকোসিস্টেম উন্নত করতে হবে। প্রচুর ৫জি টাওয়ার লাগবে, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।
৫জি নেটওয়ার্ক সেবা বিশ্বের বেশ কিছু উন্নত দেশে ইতোমধ্যে চালু রয়েছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এই সেবাকে আরো কীভাবে উন্নত করা যায়, সেটি নিয়েও কাজ করছে দেশগুলো। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরো অনেক দেশ এই সেবার সঙ্গে যুক্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিটিআরসি জানায়, বাংলাদেশে ৫জি সেবা চালুর জন্য ২.৩, ২.৬, ৩.৫ গিগাহার্জ ব্যান্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২.৩ গিগাহার্জ ব্যান্ডে ৬৫ মেগাহার্জ, ২.৬ গিগাহার্জে ১২০ মেগাহার্জ এবং ৩.৫ গিগাহার্জে ৪৬০ মেগাহার্জ বরাদ্দযোগ্য তরঙ্গ আছে। টেলিটকের পর অন্যান্য অপারেটরদের ৫জি সেবা চালুর জন্য আগামী মার্চ মাসে এসব তরঙ্গ নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হবে। #

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর