রফিকুল ইসলামঃ ২০১৮ সালের নির্বাচনী অঙ্গীকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুমাত্রিক কর্ম নির্দেশনায় ‘আমার শহর আমার গ্রাম’ প্রকল্পটি উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। গ্রামনির্ভর অর্থনীতির মহাপরিকল্পনায় আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ তৈরির মহাব্রতে সরকার সারাদেশের মতো হাওরাঞ্চলেও যে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সম্প্রসারণ করছে অর্থাৎ সময়ের গতিপ্রবাহে সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনায় উন্নয়নের যেন এক অবিস্মরণীয় অভিযোজন সমৃদ্ধির অপ্রতিরোধ্য কালপর্ব।
উন্নয়ন প্রকল্পের নিরবচ্ছিন্ন গতিধারায় অবকাঠামোগত যে দৃষ্টিনন্দন উন্নয়ন, তাও অভাবনীয় অর্জন। যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন নতুন সড়ক-মহাসড়ক, অলওয়েদার রোড বা আবুরা সড়ক, সেতু নির্মাণ শুধু দেখতেই চমকপ্রদ নয়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার নিরাপদ স্বাচ্ছন্দ্য ভ্রমণের এক অসামান্য সফলতা।
রাজধানী থেকে দুর্গম হাওরাঞ্চলে যে নিত্যনতুন যোগাযোগ কর্মকৌশল তা উপলব্ধি করে শ্যামল বাংলার সবুজ সমারোহের সঙ্গে একাত্ম যে অনবদ্য আনন্দযোগ সত্যিই এক মুগ্ধতার বিস্ময়। তাছাড়া হাওরের নৈসর্গিক প্রকৃতির শোভাবর্ধনের অবিস্মরণীয় যোগসাজশ নয়নাভিরাম এবং অপূর্ব এক আবেগাচ্ছন্ন অনুভব।
উন্নয়নের মেগা প্রকল্পে দেশ, দেশের হাওরাঞ্চল। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের পরিস্থিতি সহনশীল অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে হাওর এলাকায় সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তা করতে এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে অকল্পনীয় এলিভেটেড সড়ক, উড়ালসেতু ও রেললাইন। বাস্তবায়িত হলে তা হবে সরকারপ্রধান তো বটেই, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র তিনবারের নির্বাচিত এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের অভাবনীয় উপহার। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্বপ্ন রয়েছে তাঁর এলাকার মানুষ ‘কেবল কার’ এর মাধ্যমে অন্যত্র চলাচল করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয় যে অবিস্মরণীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা সারা বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাতে অচিরেই হাওরবাংলা তথা গ্রাম বাংলায় শহরভিত্তিক প্রাসঙ্গিক সম্ভাবনা অবারিত হবে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে মেগা প্রকল্প, তাতে গ্রামে বিদ্যমান হরেক রকম সঙ্কট দূরীভূত হয়ে শহরের মর্যাদায় উঠে আসার পথে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষেের উদ্দীপ্ত উন্নয়ন ধারা বৈশ্বিক করোনার নৃশংস ছোবলে গতি হারালেও তা আবারও নতুন উদ্যমে সম্প্রসারিত হতে সময় লাগছে না। এতে লাখো-কোটি মানুষের বেশি কর্মসংস্থান হবে। হাওরাঞ্চলে উন্নয়নের পালে হাওয়া লাগায় গ্রামের যোগাযোগ, কৃষি, উৎসব এমনকি দৈনন্দিন জীবন যাপনেও আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে; যার প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। আগে মানুষ যেখানে শহরে বা গঞ্জে যাওয়া-আসার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ও সময়ের জন্য অপেক্ষা করতো, সেখানে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মানুষ প্রয়োজন অনুসারে তা যেকোনো সময় পারে। তাছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটায় হাওর এখন বিশ্বগ্রামের অংশীদার।
দেশের মূল ভিত্তি গ্রাম। হাল পরিসংখ্যানে দেশের গ্রামের সংখ্যা ৯৮ হাজারের মতো। গ্রাম বলতেই আমাদের মানসপটে যে ছবি ভেসে উঠে তা হলো ধীরে বহমান ছোট ছোট নদী। পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। কোনো একধারে বটের ছায়ায় জিরিয়ে নেয়া কৃষকদল। দূর থেকে মনে হয় যেন সুনিবিড় স্বর্গের এক খণ্ডাংশ। স্বর্গের সেই মাটির গন্ধে ও একমাত্র বোরো মওসুমে কৃষকের কর্মযজ্ঞে ঘর্মাক্তের গায়ের গন্ধে রাজকীয় প্রাসাদ বঙ্গভবনে থাকতে নাকি ‘ভাল্লাগে না’ মহামান্য রাষ্ট্রপতির। তাই বারবার ছুটে আসেন গ্রামে, সাধারণদের সান্নিধ্যে। এছাড়া শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনার স্মৃতির পিছুটান যে ছাড়ে না। কবির ভাষায়, ‘মনে পড়ে হায় / কত স্মৃতি হায় / মধুর জীবন।’
কোভিড-১৯ বৈশ্বিক করোনা মহামারির দরুন দীর্ঘ প্রায় দু’বছর পর রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ তাই সাতদিনের সরকারি সফরে অতি আকাঙ্ক্ষিত নিজ জন্মভূমি ও তাঁর সাবেক সংসদীয় আসন হাওর কেন্দ্রবিন্দু কিশোরগঞ্জ-৪ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামসহ রাজনীতির তীর্থস্থান কিশোরগঞ্জ জেলা সদর ঘুরে এসেছেন। কবির ভাষাতে বলেন, ‘বিস্মৃতির অতলে স্মৃতিভাণ্ডার রইবে অম্লান চিরদিন।”
সাতদিনের মধ্যে পাঁচ রাতই কাটিয়েছেন শৈশবের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামের পৈত্রিক ভিটাবাড়িতে। বস্তুত ৯৫ ভাগ মানুষেরই বসবাস গ্রামে কিংবা গ্রাম থেকে উঠে আসা। তবে যারা গ্রামে থাকেনি কিংবা গ্রামের সঙ্গে যাদের বন্ধন নেই, তারা এর সুখ না বুঝলেও উপলব্ধিতে আসবে নিশ্চয়। গ্রামে কত সুন্দর ভোর হয়। পাখির কলরবে সূর্য উঠে। পাখির ডানায় ভর করে নামে সোনালী সন্ধ্যা। চারিদিকে আম, জাম, নারকেল, তাল, সুপারির বনবীথিতে একটি ছায়া ঢাকা শান্তির নীড়। এতে কতই না সুন্দর পাখিরা গান গায়। ফসলের মাঠ ডাকে হাতছানিতে। সারা দিনমান কৃষকের হালচাষ, দুপুরে রাখালের বাঁশির সুর, সন্ধ্যায় ধূলি উড়িয়ে গরুর পালের ছুটাছুটি এক অপরূপ অনুভূতি সৃষ্টি করে।
স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা সে আরেক কিচ্ছা। শুকনা মওসুমে শৈশবের বাধভাঙা দুরন্তপনায় কৃষকের সাথে লাঙল চষা, রোয়া রোপণ, পাকা ধান কাটা, হাওর-জলাশয়-বিলে গিয়ে পলোই দিয়ে মাছ ধরা, ঝড়ের দিনের আম কুড়ানো, মাটিতে পিছলাপিছলি খেলতে নদীর উঁচু পাড় হতে দূরের গভীর জলে আছড়ে পরা কিংবা শরীরে কাদা মাখিয়ে নদীর গভীর জলে লাফ দেয়া; আবার বর্ষাকালে সাগরের মতন অথৈ জলরাশিতে চোঙ্গা বা চায় পুতে, জাল ফেলে ও বরশী পেতে মাছ ধরা, নাও বাওয়া এবং উত্তাল ঊর্মিমালায় ঝাঁপাঝাপি করার তাড়া অনুভূত হয়।
সেই নানান রঙের দিনগুলো নাকি ভুলবার নয়। তাই বঙ্গভবে বসবাসকে তাঁর কাছে কারাবাসের মতন লাগে। শ্বাসরুদ্ধকর জীবন হতে খোলা আকাশ দেখতে, মুক্ত বাতাস নিতে; সর্বোপরি হাওরে বোরো মওসুমের শুরুতে কৃষক-কৃষাণীদের কর্মযজ্ঞ নিজ চোখে দেখে যেতে যাঁরা তাঁকে শিখরে তুলেছেন, সেই শেকড়ের সন্ধানে ছুটে আসেন নাড়ীর টানে – ‘হিজলের তাল বুনো ঘাস গুল্ম লতার ঝোপে, / বাশ বন, বাঁশ ঝাড় ভরা ভাদরের নদী কূলে, / ফেলে এসেছি শৈশব আনমনে কোনো এক কালে, / হারিয়ে ফেলেছি গোধূলি লগ্ন মঙ্গল ধূপে৷ / রাত জাগা চোখে জোনাকির আলো, কদমের ঘ্রাণ, / সবকিছু পলাতক সময়ের স্রোতে, পথ ভোলা / যাযাবর আমি খুজেঁ ফিরি জোয়ারে ভাসানো ভেলা / দু’পথে জড়াতে চাই ভোরের সোনা মাখা উঠোন৷ / ফিরে পাবো কী শিশির ভেজা সেই সোনালী দিন?
দূর অতীতকে জীবন্ত করে বর্তমানকে ভুলিয়ে দিতে চায় স্মৃতি। মনের বিচিত্র রং দিয়ে গড়ে ওঠা ছেলেবেলার খেলাঘর। সন্ধ্যামেঘের রক্তিমার মতো সব মুছে গেলেও আদর-স্নেহ আর ভালোবাসার স্মৃতি থাকে হৃদয়ের ডোরে বাঁধা। দাদা-দাদি, নানা-নানুর আদর আর মায়ের আদরমাখা বকুনি আর দুষ্টুমির জন্য গালে থাপ্পড় খেয়ে ছলছলে চোখ, পড়ার টেবিলে বসে ফাঁকি দেয়ার ছলে মুখস্থ কবিতা আউড়ানোর চালাকি বাবার কাছে ধরা পরায় কানমলা খাওয়া। মাকে তা শোনাবার জন্য জোরচিৎকার করায় অমনি পকেট থেকে বের করা বাবার লেমনচুষ! মা দৌড়ে এসে দেখতেন আমি হাসছি, হাসছে বাবাও। তা দেখে মা-ও হেসে ফেলতেন– সেসব স্মৃতিকথা কী ভোলা যায়? সহপাঠীদের নিয়ে কতইনা খেলার আসর – ওপেন টু বাইস্কোপ, ইচিং বিচিং, কুতকুত, এক্কাদোক্কা, কানামাছি, গোল্লাছুট, লুডু, মোরগ ও ষাঁড়ের লড়াই, মারবেল, দাড়িয়াবান্ধা, লাটিম, গিলা, কাবাডি, ডাংগুলি, ঘুড়ি উড়ানো, নৌকা বাইচ ইত্যাদি ইত্যাদি। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ভাষায়, ‘এই গ্রাম দেখে আমি বাংলাকে চিনেছি, দেশকে জেনেছি।’
‘বাংলার মুখ দেখিয়াছি’ – সেই বাংলা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’; জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ আর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ‘স্বপ্নের হাওর’।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘গ্রাম হবে শহর’ কার্যে পরিণত হয়ে হাওর এখন শহরে পরিণত হচ্ছে। কৃষিতে এসেছে যন্ত্র-সভ্যতা। ‘শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও’ – প্রবাদটি হালে খাটে না। বর্ষাকালেও তিন উপজেলায় মধ্যকার যোগাযোগের জন্য নির্মিত অলওয়দার রোড বা আবুরা সড়ক। শুকনার ছয় মাসের অধিক সময় দেশের যেকোনো স্থানে চলাচলে রইল না কোনো বাধা। রিকশা ও অটোস্ট্যাট হয়েছে। গ্রামের ফসলের সবুজ মাঠ ও হাওরের বুক চিড়ে প্যাঁ-পো শব্দে মোটর বাইক, লরি, মাইক্রো বাস ও প্রাইভেট কার ছুটে চলে শাঁই শাঁই শব্দ তুলে। রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বপ্নের হাওরে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং হাত নাড়িয়ে কৃষক ও কৃষক-বধূদের সাথে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও তাঁদের সাথে মিশা এবং খুশ দিলে সুখ-দুখের গল্প বলতে না পারায় আফসোস নাকি রয়ে গেছে। তাঁর ভাষায়, যতবাধা রাষ্ট্রীয় প্রটোকল।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপজেলা সদরে অনুষ্ঠিত জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সমাজপতিসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও মিলিত হন। সভায় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সমাজপতিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দেশ ও জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার জোর তাগিদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে অসৎ ও অন্যায় কাজে সায় দেবেন না। তাতে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়; বাড়ে কিন্তু ঘৃণার ভার।
এছাড়া সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এ দেশের মালিক জনগণ। বৈষম্যহীন জীবনযাপনের অধিকার তাঁদের আছে। সংবিধানে বর্ণিত সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
সত্য তিক্ত হলেও রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ কাব্যিকতা করে সব বলে যান, যা বিবেককে নাড়া দেয়। আগের বারের সফরে ‘মুই কি হনুরে’ বা ‘আমিই একটা কিছু’ ভাবসাব ছেড়ে রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের বলেছেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা।’ তৃণমূলের রাজনীতিক হয়েও তাঁর রাষ্ট্রপতি হবার গোমর ফাঁস করে দিয়ে বলেছেন, ‘লোকটা (আবদুল হামিদ) কারও উপকার করতে না পারুক, কারোর হক মেরে খাবে না বা কারও কোনো ক্ষতি করবে না’ – এই আস্থা ও ভরসা থেকে বড় মায়া করে এলাকার মানুষ আমাকে বার বার ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদে পাঠিয়েছেন। মানুষকে ভালোবাসা আর নীতিতে অটল থাকায় দুর্গম হাওর হতে বঙ্গভবনের বাসিন্দা হতে পেরেছি।’ তাই, কারোর ‘ক্ষতির চিন্তা’ বা ‘কুবুদ্ধি’ বাদ দিয়ে জনকল্যাণে ব্রত হয়ে রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জোরালো তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি। এবারের সফরেও সংশ্লিষ্টদের ন্যায্যতার ভিত্তিতে চলার জোরালো তাগিদ পুনর্বার ব্যক্ত করেছেন।
দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এরপরই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচসের সানাই বেজে উঠবে। কার্যত রাষ্ট্রপতি ২০১৩ সাল থেকে মাঠের রাজনীতির বাইরে রয়েছেন। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি সমাজচিত্র তাঁর অজানা। যা বলছেন তা দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা থেকে। তাঁর সাথে যাদের সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে, তারা সমাজের হোমড়াচোমরা ধরনের ব্যক্তি। তারা ব্যক্তিস্বার্থে চিনির ভালোবাসায় ‘বাইলের বৈঠা’ বাইয়া আসেন। আর নেতা হলে তো ‘পাল উড়ান’। আদতে ‘লিডার ইজ নেভার রং, লিডার ইন অলওয়েজ কারেক্ট’ – এ কনসেপ্টের হাওয়া বইছে হাওরপাড়ের গ্রামগুলোতে। এতে জনতার রাজনীতির অভিষেক না হয়ে অভিষেক হচ্ছে ব্যক্তির কর্তৃত্বপরায়ণের। সাধারণদের উপর চড়ে বসে আছেন ‘বেস্ট ওয়ান’ হয়ে।
হাওরের গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থায়ও পরিবর্তনের একটা ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সর্বজনীন শিক্ষা সুষম সমাজ গঠনে সহায়তা করে। মানুষের চেতনা ও বিবেকের পরিবর্তন ঘটায়। ফলে শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ভাবতে শিখে, সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শিখে। সমাজের অবহেলিত মানুষও শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজের জীবনযাপন এবং আয় বাড়াতে সমর্থ হয়, যা সমাজের বৈষম্য দূর করে। সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ নিজে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাকে দিয়েও একটি করিয়েছিলেন। যার ফলে হাওরের গ্রামীণ জনপদ দেখছে অন্ধকার থেকে আলোর মুখ। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহ যে স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপদ বাসভূমির অনন্য পথচলা, তাও যেন এক পরম পাওয়া। কিন্তু উন্নয়নের অবধারিত কর্মসংযোগে হরেক রকম বাধাবিপত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠায় সরকারের বিশ্বগ্রামের ধারণাটি যে অধরা ঠেকছে।
দেশের মূল ভিত্তিই হচ্ছে গ্রাম। টানা তিনবার সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের সহায়ক হিসেবে ‘আমার গ্রাম’র বাস্তবতা তুলে ধরছি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সমাজপতি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যে তাগিদ দিয়েছেন ওই রেশ ধরে। যোগাযোগ ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে যতটুকু উন্নতি হয়েছে এখানে, তার চাইতে বেশি পিছিয়ে রয়েছে আর্থ সামাজিক দিক দিয়ে। সম্প্রীতির গ্রামটি হালে উৎপীড়িত। যে কারণে বাসিন্দারা শতভাগ হামিদপ্রেমী (রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ) তথা আওয়ামী লীগার হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত হতদরিদ্র ও দরিদ্রদেরকে সরকারের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। সরকারি মালে দল নয়, ব্যক্তি ইমেজ বাড়াতে বা ব্যক্তি অনুগামী তৈরি করতে ‘তেলা মাথায় তেল’ দেয়া হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিতরা বিগত দিনে রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নালিশ করায় দুটি তদন্ত মিলেছে বটে, কিন্তু প্রতিকার জুটেনি। তাঁদের ভাষায়, ‘আমরার কি আর ক্ষ্যামতা আছে? তাই মনের কষ্ট মনে লইয়া বইয়া রইছি। হামিদ সাইবে (রাষ্ট্রপতি) আমাদের দিকে ফিরে তাকাইবার অপেক্ষায় আছি।’ তাঁদের বিশ্বাস ন্যায্যতার দিন আবার ফিরে আসবে।
মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নে ২নং ওয়ার্ডে অবস্থিত নতুন বগাদিয়া গ্রামটিতে বসবাসকারী ভূমি ও গৃহহীনসহ প্রায় ১৬৭টি পরিবারের মধ্যে ১০৫টি হতদরিদ্র এবং ৩৭টি দরিদ্র ও ২৫টির মতো মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টির মতো হতদরিদ্র পরিবার বিশেষ করে বিগত ছয় বছর ধরে বণ্টনবৈষম্যের শিকার হয়ে সরকারের সবধরনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু, সরকারি প্রকল্পের বাস্তবতা এবং কর্মক্রমের মাধ্যমে আর্থিক উন্নতি ঘটাতে সুদৃষ্টি রাখার যেন কেউ নেই। তাঁদের ভাষ্য, ‘ভোটাভুটি আইলে হামিদ সাইবের (রাষ্ট্রপতি) কতা কইয়া ভোট লইয়া যায়। ভোট গেলেগা ফিরাও দ্যাহে না। স্থানীয় নেতা-মাতাব্বরেরা উপজেলায় গিয়ে আমাদের বেচে আবার এলাকায় এসে হামিদ সা’বসহ এমপি-শীর্ষনেতাদের বেচে। তা বুইঝ্যাও বুঝিনা, চাপাকান্না ঢুকরে কাঁদে।’
‘একসময় আমাদের জীবর থমকে যায়, জীবন থামে না’ – অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনীতে এ কথা লিখেছেন। অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তা দেবার মালিক সরকার। ব্যক্তিস্বার্থপূর্ণ চেতনা ব্যক্তির চারিদিকে থাকা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাছাড়া গ্রাম্য সালিশী বিচার ব্যবস্থাকেও আবর্তিত গড়ে উঠেছে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’। এরই ধারাবাহিকতায় ৮৫ বছরের পুরানো ২নং বগাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষার একমাত্র বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র খেলার মাঠটিও ব্যক্তি মালিকানায় গিয়ে দখল হারিয়েছে। শিক্ষকদেরকেও বহুলাংশে গোমস্তা বানিয়ে রাখায় রক্ষা পাচ্ছে না বাহ্যিক শক্তির নগ্ন হামলা থেকেও। সম্প্রীতির গ্রামটিতে হালে হীরকের রাজা ভগবান।
হাওরে বিশেষ করে যোগাযোগ ও যাতায়াত উন্নয়ন তাড়া করছে। তা এক নজর দেখতে আসছে দেশের দূরদূরান্তর শরণার্থীরা। অটোরিকশা, মোটর সাইকেলসহ নানান জাতের গাড়িতে কোণঠাসা রাস্তাঘাট। এত সাফল্যের পরও দলের নয়, ব্যক্তি অনুগামিতায় শত্রুভীবিষণের দরুন রাষ্ট্রপতির স্বপ্নের হাওরের অর্থনৈতিক অবস্থা সব নাগরিকের সমস্যা দূর তথা মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেনা। আর সামাজিক ব্যাস্থায়ও নেমে এসেছে অদ্ভুত আঁধার এক।
ওপারের কালজয়ী গায়কের কণ্ঠধ্বনি দিয়েই যবনিকা টানছি– ‘মানুষ মানুষকে পণ্য করে,/মানুষ মানুষকে জীবিকা করে,/পুরোনো ইতিহাস ফিরে এলে/লজ্জা কি তুমি পাবে না… ও বন্ধু।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।