ওয়াজ মাহফিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের কল্যাণের বার্তা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ওয়াজ মাহফিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ। আবহমানকাল ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত। ওয়াজ মাহফিল থেকে মুসলমানদের ইমান, আমল, আচার-আচরণে বলিয়ান ও আদর্শ মুসলিম হওয়ার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।

আদর্শ ওয়াজ মাহফিলের রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- শায়খ আহমাদুল্লাহ

‘ওয়াজ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ, নসিহত। আল্লাহতায়ালা কুরআনে কারিমে বিভিন্নভাবে ‘ওয়াজ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘(আল্লাহ) তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করো।’ (কুরআন, ১৬:৯০)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সদুপদেশই দিন।’ (সহিহ মুসলিম : ৯৫)। আরও বলেছেন, ‘আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও।’ (সহিহ বুখারি : ৩৪৬১)। তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে মানুষকে সদুপদেশ দেওয়া ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব।

‘ওয়াজ’ তথা দিনি উপদেশ প্রদান ইসলামে নতুন কোনো সংযোজন নয়, বরং আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত ও রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থা। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার ভিত গড়ে তোলা এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের প্রধান মাধ্যম এটি।

ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হতে হবে

১. কুরআন হাদিসের আলোকে এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছে ইসলামের সঠিক ধারণা তুলে ধরা।

২. প্রচলিত কুসংস্কার ও সামাজিক অসঙ্গতি এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে দূর করার প্রয়াস চালানো।

৩. নীতিনৈতিকতায় সমৃদ্ধ দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।

৪. সর্বোপরি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

ওয়াজ মাহফিলের সময়সীমা

গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ এবং কৃষক ও গৃহিণীদের জন্য ওয়াজ মাহফিলের জন্য আদর্শ সময় বাদ আসর থেকে রাত ০৯-১০টা। তারপর মাহফিলস্থলে এশার সালাত আদায়ের মাধ্যমে মাহফিল সমাপ্ত হলে সেটা হবে সব দিক থেকে সুন্নাহ সম্মত ও যথার্থ। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে যাওয়া পছন্দ করতেন এবং এশার পর আলাপচারিতা অপছন্দ করতেন। তা ছাড়া রাতে দেরিতে ঘুমানো শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।

আলোচক ও আলোচনার ধরন

শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানুষের কল্যাণ ও দায়িত্ববোধ থেকে ওয়াজ করতে চান এবং কুরআন হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন, বিনম্রভাবে সুন্দর ও শুদ্ধ ভাষায় আলোচনা ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এমন দায়িত্বশীল ও বিচক্ষণ আলেমকেই মাহফিলে আলোচনা পেশ করার আহ্বান করা উচিত।

ওয়াজের নামে বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর অযাচিত সমালোচনা, দৃষ্টিকটু আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি করা, অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি, বানোয়াট-ভিত্তিহীন উক্তি ও মন্তব্য ওয়াজ মাহফিলের গাম্ভীর্য এবং সৌন্দর্য বিনষ্ট করে। আলোচনা হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ও গঠনমূলক। যা আগে থেকে নির্ধারণ করে নিতে পারলে ভালো হয়।

আয়োজকদের দায়িত্ব

‹ স্থানীয় আয়োজকরা মাহফিলের প্যান্ডেল প্রস্তুত, প্রচারণা, স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষা ও সার্বিক বিষয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

‹ মাহফিলের মূল উদ্দেশ্যে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, বক্তা নির্বাচন থেকে নিয়ে সবকিছুতে সে ব্যাপারে তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।

‹ ওয়াজ মাহফিলে যেন ইসলামের সুহমান দাওয়াহর আবহ থাকে। মাহফিল যেন প্রদর্শনপ্রিয়তা, বা লৌকিকতা বা এ জাতীয় কোনো মন্দ কিছুর প্ল্যাটফরম না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।

‹ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিংবা গাড়ি থামিয়ে ডোনেশন কালেকশন করার মতো অপমানকর এবং বিরক্তিকর কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

‹ ডোনেশন কালেকশনের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব হালাল উপার্জনকারীদের ডোনেশন নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

আলোচকদের জ্ঞাতব্য

‹ শুধু দিন প্রচারের দায়িত্ববোধ থেকেই মাহফিলে আলোচনা করবেন।

‹ কুরআন হাদিস ও সুন্দর উপদেশমালাকে প্রজ্ঞার সঙ্গে পেশ করে ওয়াজ করবেন। মনগড়া কোনো কথা বা বেফাঁস কোনো মন্তব্য করবেন না।

‹ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ করে কোনো আলোচনা করবেন না।

‹ মাহফিলে আলোচনা করবেন অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। পরিকল্পিতভাবে লোক হাসানো, কৌতুক করা কিংবা অসুন্দর কোনো অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলবেন না।

‹ যথাসম্ভব শ্রোতাদের প্রতি সম্মান বজায় রেখে বিনয়ের সঙ্গে আলোকপাত করবেন। শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ কিংবা সম্বোধন করতে গিয়ে ধমকের সুরে কোনো কথা বলবেন না।

‹ মাহফিলে রাজনৈতিক বা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন না।

‹ রাষ্ট্র ও সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্ন হতে পারে এমন আলোচনা থেকে বিরত থাকবেন।

‹ মাহফিলের আবেদন ফরম তৈরি করে নিতে পারেন। যাতে আদর্শ ওয়াজ মাহফিলের জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা উল্লেখ থাকবে।

প্রশাসনের অনুমোদন ও স্বচ্ছতা

ওয়াজ মাহফিলের লক্ষ্যই যেখানে নীতিনৈতিকতার দীক্ষা দেওয়া, সেখানে মাহফিল করতে গিয়ে যেন কোনো ধরনের অসততা বা অনৈতিকতার আশ্রয় নেওয়া না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য। স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করে/অনুমোদন নিয়ে মাহফিল আয়োজন করা সুশৃঙ্খল মাহফিলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বিদ্যুৎ ও মাইকের ব্যবহার

অনেক সময় মাহফিলের বিদ্যুৎ সরাসরি মেইন লাইন থেকে টানা হয়, যা অনুচিত কাজ। প্রয়োজনে আশপাশের কোনো বাসা কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে (নিরাপত্তা ও ধারণ ক্ষমতা নিশ্চিত করে) সংশ্লিষ্টদের অনুমতি ও বিল পরিশোধ সাপেক্ষে বিদ্যুৎ নেওয়া যেতে পারে।

মাহফিলের মাইক অনেক দূর পর্যন্ত স্থাপন করার দ্বারা যদি অন্য ধর্মের মানুষের বিরক্তি কিংবা কোনো রোগী বা কারও কষ্টের কারণ হয়, তাহলে তা কোনো অবস্থায়ই জায়েজ নয়। কারণ কাউকে ওয়াজ শুনতে বাধ্য করা, কিংবা সাধারণ জীবনযাত্রা ব্যাহত করা ও কষ্ট দেওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ কিংবা গান-বাজনার অনুষ্ঠানে দূরদূরান্ত পর্যন্ত মাইক স্থাপন ও হাই ভলিউমের বিরক্তিকর ব্যবহার হয়ে থাকে, সেই যুক্তিতে ওয়াজ মাহফিলেও একই কাজ করা ন্যায়সঙ্গত হবে না। কারণ মন্দ কোনো কিছু কখনো দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় হতে পারে না। ওয়াজ মাহফিল তো বরং অন্যায় ও অসঙ্গতি দূর করতে কাজ করবে।

প্রচারের নীতিমালা

‹ মাহফিলের ব্যানার বা পোস্টারের লেখা যেন বিশুদ্ধ থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।

‹ পোস্টার বা ব্যানারে কোনো আলোচকের পরিচয়-পদবি লিখতে গিয়ে ভুল ও অতিরঞ্জন করা চরম অন্যায়।

‹ উপস্থাপক কোনো আলোচকের পরিচয় উল্লেখ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন ও অত্যুক্তি করবেন না।

‹ মাহফিলস্থল ও একান্ত আশপাশের এলাকার বাইরে দূরদূরান্ত পর্যন্ত মাইক লাগানো অনুচিত কাজ। মাহফিলস্থলের আশপাশে বসবাসকারী কারও যেন কষ্টের কারণ না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

‹ মাহফিলের আলোচনা ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে প্রচার করার জন্য নিজস্ব বা নির্ভরযোগ্য মিডিয়া থাকলে ভালো। অন্য কোনো ইউটিউবার, ফেসবুকার বা মিডিয়ার ক্যামেরা অনুমোদনের আগে তাদের চ্যানেল ও পেজ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে দায়িত্বশীলতার বিষয়টি নিশ্চিত হলেই কেবল মাহফিল রেকর্ডের অনুমতি প্রদান করতে হবে।

যারা মাহফিলের ভিডিও ধারণ করে ভিউয়ার বাড়ানোর জন্য দৃষ্টিকটু, মিথ্যা ও আপত্তিকর থাম্বনেইল কিংবা শিরোনাম দিয়ে থাকে তাদের কোনো অবস্থাতেই মাহফিল রেকর্ডের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। উত্তম হয় মাহফিলের আগেই তাদের কাছ থেকে রেকর্ডের আবেদন গ্রহণ ও পুরো ব্যাপারটি এ বিষয়ে পারদর্শী কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা।

আলোচকদের সম্মানী

আলোচকদের উচিত দিন প্রচারের মানসিকতা নিয়ে ওয়াজ করা। মাহফিলে ওয়াজ করাকে যদি অন্য ১০টা পেশার মতো একটা পেশা বানানো হয় তাহলে সে ওয়াজ দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানদের খুব বেশি উপকার হবে না। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-‘তোমরা তার অনুকরণ কর যে তোমাদের কাছে (সত্যর পথে আহ্বান করে) কোনো বিনিময় চায় না। আর এমন লোকেরাই হিদায়েতপ্রাপ্ত’। (কুরআন, ৩৬:২০)। তথাপি ওয়াজ করার পর হাদিয়া বা বিনিময় দেওয়া নেওয়া জায়েজ। সারা বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম স্কলার এ ব্যাপারে একমত। কারণ সাধারণত এ জাতীয় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ নিজের সংসার ও পরিবারের ব্যয়ভার বহনের জন্য পৃথক কোনো পেশায় নিয়োজিত হতে গেলে দিন প্রচারের কাজে ব্যাঘাত ঘটে।

সে জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত আলোচকের গাড়িভাড়া, পথ খরচ এবং অন্যান্য খরচের পাশাপাশি সম্মানজনক হাদিয়া পেশ করা। এ বিষয়ে চড়া দরকষা যেমন আলোচকের জন্য শোভনীয় নয়, আয়োজকদেরও এ নিয়ে সংকীর্ণমনের পরিচয় দেওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে আগে থেকে কোনো সমঝোতা হলে সেটাও দূষণীয় নয়। তবে কর্তৃপক্ষের উচিত মুখলিস ও নিষ্ঠাবান আলেমদের দাওয়াত করার চেষ্টা করা।

অনেক আয়োজক মাহফিলের জন্য বিস্তর টাকা তুলে আলোচকদের যৎসামান্য হাদিয়া দিয়ে অবশিষ্ট্য টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বণ্টন করে নেন। কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে মাহফিলের কথা বলে টাকা তুলে মাহফিলে কম খরচ করে সেটা দিয়ে অন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজ করেন, এটা গর্হিত কাজ।

কারণ দাতা যে খাতে ব্যয়ের জন্য দান করবেন, সে খাতেই ব্যয় করা উচিত। অবশ্য সবকিছু যথাযথভাবে সম্পন্ন করার পরও যদি টাকা উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে দানকারীদের মৌন সম্মতি থাকবে, এ বিবেচনায় সে টাকা কোনো ভালো কাজে ব্যয় করতে পারেন কর্তৃপক্ষ।

আমার বিশ্বাস, উপরিউক্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে, পরিকল্পিত ও গোছানো ওয়াজ মাহফিল করা হলে সেটা হবে অনেক বেশি ফলপ্রসূ এবং উপকারী ইনশাআল্লাহ।

লেখক : ইসলামি আলোচক ও চেয়ারম্যান আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর