ঢাকা ১২:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহাসিক হাতিরপুল এখন পাখিবাবার মাজার

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ নভেম্বর ২০২১
  • ১৫৪ বার

হাওর   বার্তা ডেস্কঃ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গা ঘেঁষে জায়গাটা অনেকটা জংলি। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ। এর মধ্যেই গম্বুজাকৃতির স্যাঁতসেঁতে একটি স্থাপনা। ভালো করে না দেখলে চলতি পথে ঠাহর করা মুশকিল। প্রাচীন গন্ধ আবিষ্ট স্থাপনার একপাশের পাদদেশে বাঁধানো চাতাল। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের জরাজীর্ণ সাইনবোর্ড গাড়া। গোধূলি লগ্নে মোমবাতি জ্বলছে স্থাপনার সঙ্গের একটি ছোট্ট কুঠরিতে।

একটু এগিয়ে দেখা গেলো কয়েকজন নারী-শিশু সেখানে জড়ো হয়ে কিছু একটা করছেন। একজনকে আবার দেখা গেলো সেখানে শুয়ে থাকা একটি সারমেয়র পা ছুঁয়ে সেই হাত নিজের মাথায় ঠেকাতে। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলেন। জিজ্ঞাস করতেই জানালেন এখানে মানত করতে এসেছেন। এটা নাকি পাখিবাবার মাজার!

প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নাকি ভুল করে কোনো মাজারে চলে এলাম সেটা ভেবে একটু ভিরমি খাওয়া দশা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো স্থাপনা হাতিরপুল দেখতে গিয়ে জানা গেলো এর নতুন পরিচয়। জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার আর সরাইল বিশ্বরোড থেকে স্বল্প দূরত্বের স্থাপনাটিকে একশ্রেণির মানুষ পাখিবাবা নাম দিয়ে তার মাজার বানিয়ে ফেলেছে! স্থাপনার নিচে বসানো হয়েছে দানবাক্স। উপরেও চলছে দান-সদকা। মূল স্থাপনার পাশে বসানো হয়েছে একটি টিউবওয়েল ও টয়লেট। জানা গেলো মাঝে-মধ্যে পুলের নিচের খোলা জায়গায় নাকি আসর বসে। উপলক্ষ সেই পাখিবাবা।

 

পুরো স্থাপনা ঘিরে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সংরক্ষণের কোনো চিহ্ন চোখে পড়লো না একটি সাইনবোর্ড ছাড়া। এতেই মনে হলো তাদের দায়িত্ব বোধহয় শেষ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সরাইলের বাড়িউড়া নামক স্থানের পুলটি স্থাপন করা হয় ঈশা খাঁর আমলে। সরাইল ছিল সমতট জনপদের অংশ। সেখানে ছিল দেওয়ানি শাসন। ঈশা খাঁ এ অঞ্চলে রাজধানী স্থাপনের পর শাহবাজ আলী মতান্তরে শাহবাজ খান দেওয়ানি লাভ করেন। তিনি কাচারি নির্মাণ করেন শাহবাজপুরে। তার নিবাস সরাইল থেকে শাহবাজপুর যাতায়াতে জন্য নির্মাণ করেন একটি সড়ক। পরিত্যক্ত সড়কটি এখানো স্থানীয়ভাবে জাঙ্গাল নামে পরিচিত। এই জাঙ্গালের বাড়িউড়ায় নির্মাণ করা হয় একটি পুল। হাতির পিঠে চড়ে চলাচলের সময় দেওয়ানরা এখানে হাতিকে বিশ্রামে রাখতেন, নিজেরাও নিতেন বিশ্রাম।

 

সরকারি তথ্য বাতায়ন ও উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৬৫০ সালের দিকে শাহবাজ আলী পুলটি নির্মাণ করা হয়। প্রাচীন পদ্ধতিতে ইট, সুরকি, চুন দিয়ে খিলান করে গম্বুজের মতো আকৃতিতে এটি নির্মিত হয়। এর নিচ দিয়ে চলতো নৌকা। দীর্ঘদিন জঙ্গলবেষ্টিত থাকলেও প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ২০১৯ সালে প্রত্ন সম্পদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

প্রথমদিকে জঙ্গল পরিষ্কার করলেও এখন পুরো স্থাপনাটি অরক্ষিত মনে হলো। পুলটির চারপাশে রয়েছে চারটি সিঁড়ি। হয়তো এ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পুলটি পার হতেন দেওয়ানরা। সেই সিঁড়িতে এখন জমেছে ছ্যাতলা, ঘাস, লতা। সেখানে দেখা গেলো ভাত ছিঁটানো। হয়তো পাখি কিংবা মানত করে ছেড়ে দেওয়া মোরগ-মুরগির খাবার। সন্ধ্যা নামতেই পাশের একটি ডুমুর গাছে দেখা গেলো এক দল মুরগির আবাস। গাছের ডালে তারা সারারাত বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুরো স্থাপনায় বাসা বেঁধেছে অশত্থসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আর লতাপাতা। চুন-সুরকির এ স্থাপনার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সহজে শিকড় গেড়ে ধসিয়ে দিতে পারে আস্তরণ। আশপাশে কোনো বসতি চোখে না পড়লেও স্থাপনা ঘেঁষে টিউবওয়েল ও টিনঘেরা টয়লেট বলে দেয় লোকজনের আনাগোনা কম নয়। পাখিবাবার স্মরণে বসা আসরের নামে রাতে হয়তো জায়গাটি হয়ে ওঠে একশ্রেণির মানুষের আড্ডার জায়গা।

 

প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর যে সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে তার ছাপ এর পরতে পরতে। অনেক পর্যটকও এখানে প্রতিদিন ভ্রমণ করেন। কিন্তু চোখে পড়লো না এর ইতিহাস সম্বলিত কোনো সাইনবোর্ড। যদি কেউ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব না জেনে সেখানে যান তাহলে তার অন্য কিছু আর জানার সুযোগ নেই। সংরক্ষিত স্থাপনা যতটা পরিপাটি থাকার কথা সেটা এখানে নেই। আর পাখিবাবার মাজার বলে প্রচার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তাও সঠিকভাবে জানা যায়নি। কোনো ভ্রামণিক যদি আগ্রহের বশে সেখানে যান হয়তো পাখিবাবার মাজার শুনে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবেন। আর ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটির দিকে নজর না দিলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো জানবেই না এটি বাড়িউড়ার একটি কয়েকশ বছরের প্রাচীন পুল, যা হাতিরপুল নামে পরিচিত।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ঐতিহাসিক হাতিরপুল এখন পাখিবাবার মাজার

আপডেট টাইম : ১১:২৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ নভেম্বর ২০২১

হাওর   বার্তা ডেস্কঃ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গা ঘেঁষে জায়গাটা অনেকটা জংলি। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ। এর মধ্যেই গম্বুজাকৃতির স্যাঁতসেঁতে একটি স্থাপনা। ভালো করে না দেখলে চলতি পথে ঠাহর করা মুশকিল। প্রাচীন গন্ধ আবিষ্ট স্থাপনার একপাশের পাদদেশে বাঁধানো চাতাল। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের জরাজীর্ণ সাইনবোর্ড গাড়া। গোধূলি লগ্নে মোমবাতি জ্বলছে স্থাপনার সঙ্গের একটি ছোট্ট কুঠরিতে।

একটু এগিয়ে দেখা গেলো কয়েকজন নারী-শিশু সেখানে জড়ো হয়ে কিছু একটা করছেন। একজনকে আবার দেখা গেলো সেখানে শুয়ে থাকা একটি সারমেয়র পা ছুঁয়ে সেই হাত নিজের মাথায় ঠেকাতে। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলেন। জিজ্ঞাস করতেই জানালেন এখানে মানত করতে এসেছেন। এটা নাকি পাখিবাবার মাজার!

প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নাকি ভুল করে কোনো মাজারে চলে এলাম সেটা ভেবে একটু ভিরমি খাওয়া দশা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো স্থাপনা হাতিরপুল দেখতে গিয়ে জানা গেলো এর নতুন পরিচয়। জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার আর সরাইল বিশ্বরোড থেকে স্বল্প দূরত্বের স্থাপনাটিকে একশ্রেণির মানুষ পাখিবাবা নাম দিয়ে তার মাজার বানিয়ে ফেলেছে! স্থাপনার নিচে বসানো হয়েছে দানবাক্স। উপরেও চলছে দান-সদকা। মূল স্থাপনার পাশে বসানো হয়েছে একটি টিউবওয়েল ও টয়লেট। জানা গেলো মাঝে-মধ্যে পুলের নিচের খোলা জায়গায় নাকি আসর বসে। উপলক্ষ সেই পাখিবাবা।

 

পুরো স্থাপনা ঘিরে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সংরক্ষণের কোনো চিহ্ন চোখে পড়লো না একটি সাইনবোর্ড ছাড়া। এতেই মনে হলো তাদের দায়িত্ব বোধহয় শেষ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সরাইলের বাড়িউড়া নামক স্থানের পুলটি স্থাপন করা হয় ঈশা খাঁর আমলে। সরাইল ছিল সমতট জনপদের অংশ। সেখানে ছিল দেওয়ানি শাসন। ঈশা খাঁ এ অঞ্চলে রাজধানী স্থাপনের পর শাহবাজ আলী মতান্তরে শাহবাজ খান দেওয়ানি লাভ করেন। তিনি কাচারি নির্মাণ করেন শাহবাজপুরে। তার নিবাস সরাইল থেকে শাহবাজপুর যাতায়াতে জন্য নির্মাণ করেন একটি সড়ক। পরিত্যক্ত সড়কটি এখানো স্থানীয়ভাবে জাঙ্গাল নামে পরিচিত। এই জাঙ্গালের বাড়িউড়ায় নির্মাণ করা হয় একটি পুল। হাতির পিঠে চড়ে চলাচলের সময় দেওয়ানরা এখানে হাতিকে বিশ্রামে রাখতেন, নিজেরাও নিতেন বিশ্রাম।

 

সরকারি তথ্য বাতায়ন ও উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৬৫০ সালের দিকে শাহবাজ আলী পুলটি নির্মাণ করা হয়। প্রাচীন পদ্ধতিতে ইট, সুরকি, চুন দিয়ে খিলান করে গম্বুজের মতো আকৃতিতে এটি নির্মিত হয়। এর নিচ দিয়ে চলতো নৌকা। দীর্ঘদিন জঙ্গলবেষ্টিত থাকলেও প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ২০১৯ সালে প্রত্ন সম্পদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

প্রথমদিকে জঙ্গল পরিষ্কার করলেও এখন পুরো স্থাপনাটি অরক্ষিত মনে হলো। পুলটির চারপাশে রয়েছে চারটি সিঁড়ি। হয়তো এ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পুলটি পার হতেন দেওয়ানরা। সেই সিঁড়িতে এখন জমেছে ছ্যাতলা, ঘাস, লতা। সেখানে দেখা গেলো ভাত ছিঁটানো। হয়তো পাখি কিংবা মানত করে ছেড়ে দেওয়া মোরগ-মুরগির খাবার। সন্ধ্যা নামতেই পাশের একটি ডুমুর গাছে দেখা গেলো এক দল মুরগির আবাস। গাছের ডালে তারা সারারাত বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুরো স্থাপনায় বাসা বেঁধেছে অশত্থসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আর লতাপাতা। চুন-সুরকির এ স্থাপনার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সহজে শিকড় গেড়ে ধসিয়ে দিতে পারে আস্তরণ। আশপাশে কোনো বসতি চোখে না পড়লেও স্থাপনা ঘেঁষে টিউবওয়েল ও টিনঘেরা টয়লেট বলে দেয় লোকজনের আনাগোনা কম নয়। পাখিবাবার স্মরণে বসা আসরের নামে রাতে হয়তো জায়গাটি হয়ে ওঠে একশ্রেণির মানুষের আড্ডার জায়গা।

 

প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর যে সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে তার ছাপ এর পরতে পরতে। অনেক পর্যটকও এখানে প্রতিদিন ভ্রমণ করেন। কিন্তু চোখে পড়লো না এর ইতিহাস সম্বলিত কোনো সাইনবোর্ড। যদি কেউ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব না জেনে সেখানে যান তাহলে তার অন্য কিছু আর জানার সুযোগ নেই। সংরক্ষিত স্থাপনা যতটা পরিপাটি থাকার কথা সেটা এখানে নেই। আর পাখিবাবার মাজার বলে প্রচার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তাও সঠিকভাবে জানা যায়নি। কোনো ভ্রামণিক যদি আগ্রহের বশে সেখানে যান হয়তো পাখিবাবার মাজার শুনে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবেন। আর ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটির দিকে নজর না দিলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো জানবেই না এটি বাড়িউড়ার একটি কয়েকশ বছরের প্রাচীন পুল, যা হাতিরপুল নামে পরিচিত।