হাওর বার্তা ডেস্কঃ টসটসে লাল রঙা চেরি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। এটি প্রুনাস গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রকার ফল। কেক, পেস্ট্রি, পুডিং ও টপিং এ স্বাদ ও মিষ্টতার জন্য চেরি ব্যবহার হয়। এছাড়া জ্যাম, জেলিসহ নানা পদের রান্না ও সালাদেও এর উপস্থিতি আছে।
নরম, সরস ও টসটসে রসালো এ ফলটি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যকরও বটে। কারণ এটিতে ক্যালরি খুবই কম এবং পুষ্টিগুনও বেশি। চেরিতে রয়েছে পলিফেলন, ক্যারোটিনয়েডস, ভিটামিন সি, ফাইবার এবং পটাশিয়াম। আসুন জেনে নিই চেরি ফলের স্বাস্থ্য উপকারিতা, প্রকারভেদ ও পুষ্টিগুন সম্পর্কে-
শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস
চেরিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন পলিফেনল, ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন সি, ফাইবার ও পটাশিয়াম রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে চেরিতে ব্ল্যাকবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি বা স্ট্রবেরির তুলনায় উচ্চমাত্রায় অ্যান্থসায়ানিনস, সায়ানিডিন এবং হাইড্রক্সিসিনামেট বিদ্যমান। চেরি মানুষের শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ চেরি নিয়মিত খেলে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ও চুল পড়া হ্রাস হয়।
ভাল ঘুম ও মন প্রফুল্ল রাখতে
গোটা চেরি বা চেরির জুস শোবার আধা ঘণ্টা আগে খেয়ে ঘুমালে ভাল ফল পাওয়া যায়। চেরিতে থাকা মেলাটোনিন নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ঘুমের সময় ও মান বৃদ্ধি করে। তাছাড়া চেরি শরীর থেকে করটিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে যা মন প্রফুল্ল রাখে, চাপ ও উদ্বেগ কমায়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস থেকে সুরক্ষায়
চেরিতে ক্যালরির মাত্রা কম থাকায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীরাও খেতে পারেন। তাজা চেরির গ্লাইসেমিক সূচক মাত্র ২২। গ্লাইসেমিক সূচক হল খাদ্যে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা নির্ধারণকারী একটি সূচক। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য যেসব খাবারের জিআই মান ৫৫ এর কম সেই সব খাবার গ্রহণ করা ভাল কারণ তা সহজেই হজম হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে। চেরি ফলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্থসায়ানিন ইনসুলিন উৎপাদন বৃদ্ধি করে রক্তের চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
চেরি পলিফেনল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা হৃদরোগ প্রতিরোধ করে ও ভিটামিন বি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে অ্যান্থসায়ানিন সমৃদ্ধ চেরির রস রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। অন্য একটি গবেষণায়, ২৭৫ জন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে টক চেরির রস পানে দেখা গেছে যে তাদের রক্তচাপ কমে গেছে। চেরি ফলে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম ও ভিটামিন সি আছে যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। যাদের রক্তচাপ সমস্যা রয়েছে তারা নিয়মিত চেরি ফল খেলে উপকার পাবেন।
ওজন নিয়ন্ত্রণে
টক চেরি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে টক চেরির রস মানুষের শরীরের এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। অন্য একটি গবেষণায়, ইঁদুরের ওপর টক চেরির রস প্রয়োগে লিপিড প্রোফাইল, রক্তচাপ, সুগার নিয়ন্ত্রণে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। চেরি ফলে ক্যালরির মাত্রা ও গ্লাইসেমিক সূচক কম এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে। ফলে ক্ষুধা কম অনুভূত হয় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এতে থাকা ফাইবার অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে সুস্থ রাখে।
ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে
ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে চেরি ফল। চেরিতে থাকা ভিটামিন ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ব্যাপক গবেষণায় ক্যানসার চিকিৎসায় চেরি একটি থেরাপি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিয়মিত চেরি ফল খেলে দেহে যে ডেড সেল বা কোষ থাকে সেটা শক্তিতে পরিণত হয়ে থাকে।
পেশীর ব্যথা উপশমে
গবেষণায় দেখায় যে চেরিতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগগুলো ব্যায়ামের কারণে হওয়া পেশীর ব্যথা উপশমে সহায়তা করে। ভালোভাবে প্রশিক্ষিত পুরুষ ক্রীড়াবিদদের ওপর করা একটি গবেষণায় পাওয়া যায় চেরির অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ ক্ষমতা কঠোর ব্যায়ামের পরে শক্তি পুনরুদ্ধার করে। ক্রীড়াবিদদের কার্বোহাইড্রেট পানীয় এর বিকল্প হিসেবে কম জিআই সমৃদ্ধ চেরির জুস দেওয়া হয়।
রয়েছে নানা প্রকারভেদ :
যদিও চেরির একশরও বেশি জাত আছে, সেগুলো আবার প্রধান দুটি প্রকারে বিভক্ত- মিষ্টি চেরি (প্রুনাস এভিয়াম) ও টার্ট বা টক চেরি (প্রুনাস সিরাসাস)।
মিষ্টি চেরি- মিষ্টি চেরি কালো চেরি নামেও পরিচিত। বিভিন্ন সুপারমার্কেট ও মুদি দোকানগুলোতে এগুলো পাওয়া যায়। মিষ্টি চেরি বেশিরভাগ তাজা খাওয়া হয়। এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তাজা মিষ্টি চেরি পাওয়া যায় এবং সারা বছর প্রক্রিয়াজাত চেরি পাওয়া যায়। এগুলো স্বাদে মিষ্টি এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে জনপ্রিয়। সালাদ,স্মুদি, টপিং হিসেবে বহুল ব্যবহৃত।
টক চেরি- টক চেরির জাতগুলোর মধ্যে কেন্টিশ, মোরেলো ও মারাস্কা চেরি অন্যতম। মন্টমোরেন্সি চেরি আরেকটি জনপ্রিয় টক চেরি। সামান্য টক স্বাদের জন্য অনেক রেসিপিতে এগুলো ব্যবহার করা হয়। প্রায় ৯৭ শতাংশ টক চেরি রান্না ও বেকিং-এ ব্যবহৃত হয়। চাহিদা পূরণের জন্য এগুলো শুকনো, জুস ও হিমায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়।
চেরির পুষ্টিগুন :
১০০ গ্রাম চেরিতে মাত্র ৯৭ গ্রাম ক্যালোরি থাকে। চেরিতে পাওয়া পুষ্টি উপাদানগুলো হলো : ক্যালোরি- ৯৭ গ্রাম, প্রোটিন- ১.০৬ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট- ১৬ গ্রাম, ফাইবার- ২.১ গ্রাম, ভিটামিন সি- ৭ মি.গ্রা, পটাসিয়াম- ২২২ মি.গ্রা, ক্যালসিয়াম- ১৩ মি, ম্যাগনেসিয়াম- ১১ মি.গ্রা, ক্যারোটিন-৩৮.০০ মাইক্রোগ্রাম, মেলাটোনিন-১.৬০ মাইক্রোগ্রাম
পুষ্টিতে ভরা এই ফলটি ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, অ্যান্থোসায়ানিন, ফাইবার এবং অন্যান্য পুষ্টির একটি ভাল উৎস যা শরীরের সঠিক কার্যকলাপের জন্য অপরিহার্য। ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের বিপাকীয় কার্যকারিতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাছাড়া বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে।
আরেকটি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ পটাসিয়াম যা স্নায়ুতন্ত্র, পেশীর কার্যকারিতা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। চেরি ফল উচ্চ ফাইবার যুক্ত ফল, যাদের কোষ্ঠ্যকাঠিন্য ও অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ আছে তাদের জন্য এই ফলটি খুব উপকারী।
চেরি ভিটামিন এ, সি,ই এবং অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ। চেরির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। চেরি প্রশান্তির ঘুম আনে, মন প্রফুল্ল রাখে,প্রদাহ প্রশমনে কাজ করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধেও এর সুনাম আছে। তাছাড়া চেরিতে থাকা ফাইবার অন্ত্র পরিষ্কার রাখে।
আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করতে পারেন উপকারী এই ফলটি।