হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাকিস্তানের করাচি। মাচার কলোনি। শীর্ণ কুটিরে ঠাসা একটা বস্তি। ঘিঞ্জি ঘরের এক সামষ্টিক রূপ। ভাঙা অলিগলি। মৌলিক মানবাধিকারের বালাই নেই এখানে। আনুমানিক ৭ লাখ লোকের বাস এখানে। এখানকার প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ জাতিগতভাবে বাঙালি। যাদের অধিকাংশেরই নেই নাগরিকত্ব কিংবা অন্য কোনো সনদ। আর এ কারণেই তাদের কারো নেই কোনো ব্যাংক হিসাব, তরুণ-যুবাদের অধিকাংশেরই নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কারণ, নাগরিকত্বই তো নেই তাদের, কোন স্কুল ভর্তি নেবে তাদের? আর তাই, ছোটবেলা থেকেই তাদের স্বপ্নগুলো থাকে ধূসর। পাকিস্তানে জন্ম হলেও তারা যে বাঙালি। পাকিস্তানিরা তাদের বলে ‘এলিয়েন’।
শৈশবের সঙ্গী দারিদ্র্য : এখানকার শিশুদের জন্মগত সঙ্গী যেন একটাই-চরম দারিদ্র্য। এখানে ‘খেল’ নামের শিক্ষা, খেলাধুলা ও বিনোদননির্ভর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিই যেন শিশুদের একমাত্র ‘আনন্দজগৎ’। এখানে ১৭০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে নানা ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এখানে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের সংগীত, খেলাধুলার নানা কলাকৌশল শেখানো হয়। পাকিস্তানে জাতিগত বাঙালি রয়েছে আনুমানিক ২০ লাখের মতো। তারাই এখানে সবচেয়ে বৈষম্যমূলক জাতিগত সম্প্রদায়। তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানে বসবাস করে আসছেন। আবার তাদের অনেকের পাকিস্তানেই জন্ম। অথচ জাতিগত এই বাঙালিরা এখনো কোনোরূপ সরকারি স্বীকৃতি কিংবা নাগরিকত্ব-সনদ থেকে বঞ্চিত। তারা ভোট দিতে পারে না বা জনস্বাস্থ্যসেবা বা সরকারি স্কুলে প্রবেশাধিকার পায় না। পাকিস্তান বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুহাম্মদ সিরাজ অনুযোগের সুরে বলেন, ‘তারা আমাদের এলিয়েন, শরণার্থী কিংবা বিদেশি বলে অভিহিত করে; আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে। কিন্তু আমরা এই দেশে স্বীকৃতি পেতে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা বাঙালি ঠিকই, কিন্তু আমরা পাকিস্তানি বাঙালি।’
কষ্ট বেশি শিশুদেরই : কিরন জাফর এবং কুলসুম ইয়ামির ‘খেল’-এ প্রশিক্ষণ পাওয়া জিমন্যাস্ট। তাদের স্বপ্ন পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু জাতীয়ভাবেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অধিকার নেই ওদের, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা তো সেখানে সুদূরের স্বপ্ন। ১৯৫১ সালের পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, আইনটি শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী যে কোনো ব্যক্তির নাগরিকত্ব দাবি করার অধিকার রয়েছে। কিরন আর কুলসুমের বাবা-মায়েরও জন্ম পাকিস্তানেই। কিন্তু ওদের কারোই আইডি কার্ড নেই।
আইনজীবী তাহেরা হাসান বলেন, ‘পাকিস্তানে জন্মগত অধিকারের আইনটি অন্যতম প্রগতিশীল আইন হিসাবেই বিবেচিত। এটি মোটেই বৈষম্যমূলক নয়। মূল সমস্যাটি বাস্তবায়নের স্তরেই। ফলে এই শিশুরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। নাগরিকত্ব নিশ্চিতকারী কোনো আইনি দলিল ছাড়া তারা পাবলিক স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। তাদের যথাযথ শিক্ষা বা এমন কিছু অর্জনের সম্ভাবনাগুলো অচল হয়ে পড়েছে।
‘নারা’ কার্ডের ফাঁকফোকর : প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর যেসব বাঙালি পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের প্রথম ম্যানুয়াল আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। সমস্যা শুরু হয় ২০০০ সালের পর, যখন পাকিস্তানের আইডি কার্ডের ডিজিটালাইজেশন শুরু হয়। আইনজীবী তাহেরা হাসান বলেন, ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে সব নাগরিকের পক্ষে সরকারের চাওয়া যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক এ সময়েই অভিবাসী এবং বিদেশি বাসিন্দাদের নিবন্ধন করার জন্য গঠিত হয় ‘নারা’ (ন্যাশনাল এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন অথরিটি)। ফলে তারা পায় ‘নারা’ কার্ড। শুরু হয় পদ্ধতিগতভাবে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ। আর ‘নারা’ কার্ড পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
কথা রাখেননি ইমরান খান : ২০১৮ সালে, নির্বাচনে জয়ের আগে, ইমরান খান পাকিস্তানে বাঙালিদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাঙালি শিশু, যারা পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছে, এমনকি যাদের পূর্বপুরুষরাও কয়েক দশক ধরে দেশে বসবাস করছে এবং জন্মগত অধিকার সত্ত্বেও নাগরিকত্ব পাচ্ছে না, তার পিটিআই পার্টি জয়ী হলে এ বাঙালিরা আইডি কার্ড পাবে।’ অথচ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
নিষ্পেষিত, নির্যাতিত বাঙালিরা : পাকিস্তানে চরমভাবে নির্যাতন আর নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছেন এই বাঙালিরা। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আসাদ ইকবাল বাট বলেছেন, ‘পাকিস্তানে একজন অবাঙালি শ্রমিক যেখানে মাসে ১২-১৩ হাজার রুপি মজুরি পান, সেখানে একই শ্রম দিয়ে একজন বাঙালি পান তার অর্ধেক। তাছাড়া বাঙালি মেয়েরা ফ্যাক্টরি, বাসাবাড়িতে কাজ করে শুধু যে টাকা কম পায় তা নয়, যৌন নিপীড়নের শিকারও হচ্ছে তারা।