স্বাধীনতার ৪৪বছর পেরিয়ে গেলেও নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ৯ বীরাঙ্গনা আজও পাননি স্বীকৃতি। সরকার ঘোষিত সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। ১৯৭১ সালে দেশ-মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে এই সব নারীরা বীরোত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও আজ পর্যন্ত রাষ্টীয় সম্মান পাননি।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা গ্রামের প্রয়াত বাণী রাণী পাল, রেনু বালা, মায়া সূত্রধরসহ ৯
জন বীরাঙ্গনা। একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রনা, সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি দুঃখ-দুদর্শা আর অভাব অনটন, আর অসুস্থ্যতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা সারা দেশে ৪৪জনকে বীরাঙ্গনা নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সেই তালিকায় উত্তর জনপদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত আব্দুল জলিলের জন্মভূমি জেলা নওগাঁর রাণীনগরে ৯জন বীরাঙ্গনার নাম তালিকাভূক্ত না হওয়ায় হতাশ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে ছায়ায় ঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক হানদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের প্্রত্যক্ষ সহযোগীতায় প্রকাশ্য দিবালোকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায়। এই সময় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নীসংযোগ, লুটপাটসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী, ও বিভিন্ন বয়সী নারীদেরকে ধরে ওই গ্রামের সুরেস্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে”জয়বাংলা বলতে হ্যায় নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়”এভাবে পাক সেনারা ব্যাঙ্গাত্তো উক্তি করতে করতে ব্রাশ ফায়ার করে গবীন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারন পালসহ ৫২ জন মুক্তি কামী জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করে।
এ সময় পাক হানদার বাহিনী গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংস লীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর শেষ আকুতিটুকু করলেও পাক-জান্তাদের মন গলাতে পারেনি। উল্টো পাক-জান্তারা সুযোগ বুঝে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। ৫২ শহীদের তাজা রক্তে সে দিন নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর পানি লাল হয়ে ভাসিয়ে যায়। নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদ ও কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল।
সরেজমিন আতাইকুলা গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিতে যখন কালীদাশি পালের বাড়িতে উপস্থিত তখন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিবেশী একজন তাকে খবর দেওয়ার পর পার্শ্বে চাতালে কাজ ফেলে রেখে বাড়িতে ছুটে আসলেন। কিছুক্ষনের জন্য কথা হয় তার বাড়ির আঙ্গীনায় বসে।
১৯৭১ সালে এই গ্রামে পাকবাহিনীর নির্যাতনের আলাপকালে ৯ বীরাঙ্গনার মধ্যে কালীদাশি পাল (৭২) জানান, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবী আসে তখন আমর স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আতœগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকাদের সহযোগীতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবীরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও তারা নানান কায়দায় নির্যাতন চালায়। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সে দিন মজুরের কাজ করে। আমি ও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিম্বা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি।
স্বাধীনতার ৪৪বছর পার হলেও আমাদের খোঁজ খবর কেউ নেয়নি। আপনারা (সাংবাদিকরা) আসছেন যদি পেপারে দিয়ে রাষ্ট্রের সু-নজরে আসে জীবনের এই পরন্ত বিকেলে আর্থিক কিছু সুবিধা পেলে অভাবের সংসারে কিছুটা কাজে লাগতো।
সুষমা পাল (৬৯) জানান, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবীরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাংচুড় ও অগ্নীসংযোগসহ নানা ধরণের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্র ছেলেকে নিয়ে পার্শ্বের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় নেই। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবীরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক-বাহিনীরা মেয়েদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে।
সদ্য প্রয়াত বাণী রানী পালের মা ও ছোট ভাই জয়ন্ত পাল জানান, একাত্তরের ঘটনার কথা জানতে চাইলে মাথা নিচুঁ হয়ে যায় তাদের। ক্ষোভে কষ্টে তাদের চেহারা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠে। তার পরও বলেন, একাত্তরের ২৫ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে নদী পার হয়ে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাক বাহিনী আমাদের পাড়ায় ঢুকে লুটপাট, ভাংচুড়, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে বাণী পালের চোখের সামনে তার বাবা শ্রীমন্ত পালকে ধরে মারপিট শুরু করে। সাথে সাথে বীরের মতো সেই সময়ের কিশোরী বাণী পাল পাঞ্জাবীদের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে পাশের একটি কূপে ফেলে দিয়ে হাতাহাতি শুরু করলে পাক-হায়েনারা তার বাবাকে গুলি চালালে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় ভাগ্যেক্রমে সে বাঁচলেও বাণী পাল তাদের নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে রেহায় পায়নি।
এক পর্যায় দেশে স্বাধীনতার পতাকা বাতাসে পটপট করে উড়লেও দেশে সরকার আসে সরকার যায় ৪৪বছর পরও আমাদের খোঁজ কেউ নিতে আসেনি। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে জয়ন্ত এক পর্যায় বলেন, লজ্জা ঘৃণায় আমার দিদি বিবাহ না করেই অবশেষে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থ অভাবে যথাযথ চিকিৎসা করতে না পেরে মারা গেলেন। তবে অন্য ৬ জন বীরাঙ্গনা রেণু বালা, ক্ষান্ত বালা পাল, মায়া সূত্রধর, রাশমুনী সূত্রধর, সন্ধ্যা পাল, সুষমা সূত্রধর ও তাদের স্বজনরা লজ্জা ঘৃণা, ক্ষোভে স্বজন হারানোর বেদনায় তারা মুখ খুলতে রাজি নয়।
আতাইকুলা গ্রামের শহীদ পরিবারের সদস্য গৌতুম পাল জানান, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক সময় অতিবাহিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের বীরোত্ব গাঁথা এই গ্রামের শহীদ ও বীরাঙ্গনার পরিবারের সদস্যরা রাষ্টীয় কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের নামের স্থান হয়নি বড় পরিতাপের বিষয় যে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও এ দপ্তর সে দপ্তর ঘুরেও আমাদের কোনো একটা সুরাহা হলো না।
রাণীনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সহকারি কমান্ডার (সাংগঠনিক) নূরুল ইসলাম জানান, আতাইকুলার ৯বীরঙ্গনার ব্যাপারে যথযথা প্রক্রিয়ায় আবেদন করা হয়েছে। আমরা এখন গেজেটভূক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছি।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম বলেন, বর্তমান প্রধান মন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। আতাইকুলা গ্রামের ৯ বীরাঙ্গনার ব্যাপারে নিয়ম মাফিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাতে তারা তালিকাভূক্ত হতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।