বিশ্বজিতের রক্তে সর্বানন্দের আস্ফালন

পীর হাবিবুর রহমান:

সর্বানন্দে সর্বনাশ হচ্ছে। সরকার একদিকে দেশজুড়ে উন্নয়নের চাকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিচ্ছেন। সরকার বিরোধী আন্দোলনের আলামতও নেই। সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতার দম্ভ ও উন্মাষিকতায় মানুষ অতিষ্ঠ করছেন সরকারি দলের সর্বানন্দরা।

স্থানীয় সরকারি দলের প্রভাবশালী এমপি নেতার লোক হয়ে মানুষের উপর জুলুম করছেন। ক্ষমতার আনন্দ তাদে সর্বাঙ্গে। ক্ষমতার উন্মাক্ততা তাদের আগ্রাসী করে তুলেছে। সরকার সমর্থক হয়েও এইসব উন্নাসিকদের হাত থেকে জীবন অসম্ভব, রক্ষা করতে পারছে না মানুষ।

হাওর বেষ্টিত সীমান্ত জেলা সুনামগঞ্জের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহু যুগের। প্রাকৃতিক নিস্বর্গের লীলাভূমি সুনামগঞ্জে জন্মেছেন খ্যাতিমান বাউল ও বরমী সাধকগণ। জেলার কৃতি সন্তানরা রাজনীতি প্রশাসন ও কুটনীতিতে রেখেছেন অনন্য সাধন ভূমিকা। কিন্তু চলমান অসুস্থ রাজনীতি বেয়ারাপনা ছন্দপতন ঘটাচ্ছে মানুষে মানুষের। শতবছরের বহমান মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনে।

সম্প্রতি জলজোৎস্না, প্রেম ও কবিতার শহর সুনামগঞ্জে দিন দুপুরে যুবলীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বিশ্বজিত চৌহানকে নৃসংশভাবে হত্যা করেছে। খুনিদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন দলেরই এক তরুণ উন্নাসিক হাইব্রিড নেতা। উড়ে এসে রাজনীতিতে জুড়ে বসা এই তরুণকে পেয়ে উন্মত্ত যুবলীগের একটি অংশ সর্বানন্দে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রকৃত খুনিরা এখনো ধরা পরেনি। সুনামগঞ্জে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সর্বদলীয় সমাবেশ হয়েছে। শান্তির শহরে প্রকাশ্য দিবালকে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের শিকার বিশ্বজিতের রক্তের দাগ শুকায়নি। মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। পরিবারের সুখের বিলাপ শেষ হয়নি।

এরমধ্যেই জেলার ধর্মপাশার থানায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সর্বানন্দ তালুকদার দুই স্কুল শিক্ষিকাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেছেন। সর্বানন্দ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাই নন, প্রভাবশালীই নন, ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি সভাপতিও। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে নয়টায় তার দল-বল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা দিপালী রানী দাশকে পাঠদান বন্ধ করে স্কুল থেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু সর্বানন্দের হুকুম তামিল না করে শিক্ষিকা দিপালী পাঠদান চালু রাখায় মাইন্ড করেন তিনি। এ সময় সর্বানন্দ হুকুম দেন তার ক্যাডারদের। সর্বানন্দে সঙ্গে আসা বিমল, কমল, সন্তুস, লিটন, র‌্যাংটুসহ সবাই শিক্ষিকার উপর আক্রমন শুরু করে। চলে এলোপাথারি কিল-ঘুষি লাথি। পাশের কক্ষেই পাঠদানে ব্যস্ত ছিলেন সহকারী শিক্ষিকা মনির আলী তালুকদার। দিপালীকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাকেও মারধর কর হয়। এ সময় তার দুই হাতে ও পিঠে দেয়া হয় কলমের ক্ষতচিহ্ণ।

এই ঘটনায় শিক্ষক সমাজ সারাদেশে প্রতিবাদ মুখর হয়েছে। স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি করছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মহাত্ম দিকে দিকে শুনিয়ে পালন করা হলেও এখনো এই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

শুধু সুনামগঞ্জ নয়, সারাদেশেই সরকারি দলের এমপি তাদের ডানহাত বাম হাত স্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃত্ব ও প্রসাশনের কিছু কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা কর্মচারী গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট ক্ষমতার উন্মাদনায় নানা অপকর্ম করছেন। ভয়ে মানুষ তঠন্থ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড ম্লান হচ্ছে। এক সুনামগঞ্জেই ক্ষমতাশীন দলের ক্যাডারদের আক্রমণে বিশ্বজিতের রক্তের উপর সর্বানন্দরা শিক্ষিকার গায়ে উপর যেমন হামলে পরছে তেমনি দেশজুড়ে নানাস্থানে ঘটছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

সরকার ও প্রশাসনকে সরকারি দলের ক্ষমতার উন্নাসিকতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা এই সব বখাটে সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা না করলে আজ হোক কাল হোক একদিন চড়া মাশুল দিতে হবে। এই দুটি ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, শারিরীকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারাও সরকারি দলেরই সমর্থক। এসব ঘটনা সরকারি দলের নিজ গৃহেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে সরকারি দলের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেটের বাইরে, সরকার দলীয় প্রভাবশালীদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে শান্তিপ্রিয় নিরীহ জীবনযাপন করলেও রেহাই নেই। নিকট অতীতে লক্ষ্ণীপুর ও নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ড স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের উন্নাসিকরাই ঘটিয়েছেন। দু’দিন আগে সিলেট এমসি কলেজে ছাত্র লীগের দুই গ্রুপের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।

সরকার গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ দিচ্ছে, বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের বই দিচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনভাতা বাড়িয়েছে, সমুদ্র বিজয় ও সীমান্ত চুক্তির ফসলই ঘরে তুলেনি, পদ্মা সেতুর মতো চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে বসেছে। দেশজুড়ে বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতাই দেয়া হচ্ছে না, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানীও বাড়িয়েছে। দেশজুড়ে সড়ক, ব্রীজ, কালভার্ট ব্যাপকহারে নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এই সব বিষয়ের দিকে নেতাদের নজর নেই।

ক্ষমতার দম্ভ, আধিপত্য বিস্তার ও দুর্নীতির পথ ধরে আখের গোছানোর মতলববাজিতে এতটাই ব্যস্ত যে, সরকারের সকল অর্জনকে ধূলোয় লুটিয়ে দিচ্ছেন। মাঠ পর্যায়েও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি মাথা তুলতে পারছে না। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানুষের নাভিশ্বাস উড়ছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ‘অপরাধীর কোনো দল নেই’ এই নীতিতে সবার জন্য সংবিধান ও আইনের অধিকার সমান এই দর্শনে কঠোর হতে হবে। দুষ্ট গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল অনেক উত্তম এটি উপলব্ধি করতে হবে। দলীয় ক্ষমতাবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যেসব উন্নাসিক দাম্ভিকরা মাঠ পর্যায়ে যে অন্যায় অবিচার করছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর