বেদে বহর

মনির হোসেনঃ ময়মনসিংহ শহরের উপকণ্ঠে রাজ গৌরীপুরে জন্ম বিধায় পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনার কথা ছিল না। কিন্তু বাবার কর্মস্থল ভাটি এলাকা হওয়ায় শৈশব-কৈশোর কেটেছে ভাটির নানা বৈচিত্রতায়। কখনো দেখেছি দিগন্তজুড়ে সবুজ শষ্যের ঢেউ, কখনো দেখা দিয়েছে মাঠভরা সোনা ধান। আবার কখনো সাগর সমেত হাওরে আছড়ে পড়া ঢেউ এ সংগ্রামী মানুষের জীবনচিত্র। এমনই এক বৈচিত্রময় ভাসমান জীবনমান নিয়ে আমার এবারের লেখা। শুনাচ্ছি বাইদ্যাদের জীবনের টুকরো গল্প।

হাওর এলাকায় লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমির ধান কাটার জন্য শ্রমিক আসতো রাজশাহী এবং পাবনা থেকে। চৈত্র মাসের শেষ থেকেই মানুষ অপেক্ষায় থাকতো কখন পাবনা বা রাজশাহীর দাওয়াল (ধান কাটার শ্রমিক) আসবে। মাসাধিক সময় ধান কেটে পানসি নৌকায় ভরে ধান নিয়ে চলে যেতো তারা। তার পরপরই নয়া পানির স্রোতে ভেঁসে ভেঁসে আসতো বাইদ্যা নৌকার বহর। তবে দাওয়ালদের বাড়ি জানা থাকলেও বাইদ্যাদের বাড়ি কোথায় তা আমরা জানতাম না। জ্যৈষ্ঠমাসে তারা আসে শুধু সেটাই জানতাম। নারীকেন্দ্রিক এ বেদে সম্প্রদায়ের কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। নৌকাই তাদের ঘর, নৌকাই তাদের বাড়ি।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পুরুষ বেদেদের বলা হয় বাইদ্যা। আর মহিলাদের বলা হয় বাইদ্যানী। তারা শাড়ী কাপড়কে দু’টুকরো করে বিশেষ কায়দায় পড়ে। কোলের সন্তানকে বেঁধে রাখে পিঠে কিংবা কোমড়ে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বাদ্যানীরাই আয়-রোজগার করে সংসার চালায়। তারা সাপ এবং ওষুধ নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে যায়। সাধারণ রোগের টুকটাক চিকিৎসা করে। সাপ খেলা দেখায়। বিনিময়ে মুষ্টিমুষ্টি চাল, টাকা সংগ্রহ করে। বিশেষ করে ঝাড়-ফুঁক-এর কাজ করে, সিঙ্গা লাগায়, বিভিন্ন রোগের ঔষুধ ও তাবিজ বিক্রি করে, অনেকে আবার জাদুও দেখায়। এভাবেই তারা সংসারের অন্ন জোগায়, সংসার চালায়। দিনশেষে ফিরে আসে নৌকায়। বাইদ্যাগণ নিজ নিজ নৌকায় রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সাজিয়ে রাখে তাদের ছোট্ট নৌকোঘর।

বাইদ্যাগণ নৌকার বহর নিয়ে এখান থেকে ওখানে নোঙর ফেলে। প্রতিটি বহরে ১০ থেকে ১৫ টি ছোট ছোট নৌকা থাকে। পিঁপড়ার মতো সাঁরি বেঁধে চলে ওসব নৌকা। সারির প্রথমেই থাকে সর্দারের নৌকা। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হলেও সর্দার থাকে পুরুষ। বাইদ্যানীদের আয়ের একটি অংশ পায় বাইদ্যা সরদার। সর্দারের কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য নেই কারো। তার ইচ্ছাতেই তারা এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় যায়। ছোট নৌকায় টাসাটাসি করে বসবাস করে তারা।

বাইদ্যানীরা দলবেঁধে বসবাস করে। সাজসজ্জা তাদের অন্যতম আনুসঙ্গিক। তারা উঁচু করে খোঁপা বাঁধে, কপালে পরে বড় টিপ। পায়ে মল বা রূপার নূপুর পরা তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাদের কাপড় পরার ধরন বাঙালী মেয়েদের চেয়ে একটু আলাদা। দশ হাত কাপড় দুই খণ্ড করে এক খণ্ড নিচে পরে, অন্য খণ্ড গলার সাথে বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়ে দেয়। সঙ্গে বড়গলার ব্লাউজ পরে। বর্তমানে অবশ্য কাপড় খণ্ড না-করে রাজস্থানী কায়দায় পরতে দেখা যায়। তাদের সাজসজ্জার বিশেষ কারণ হলো মানুষকে আকৃষ্ট করা, যেন তাদের ব্যবসা ভালো হয়।

বেদেদের গায়ের রং তামাটে কিংবা তৈলাক্ত কালচে। তবে মাঝে মাঝে অপরূপ রূপের বাইদ্যা-বাইদ্যানীও দেখা যায়। এই অতি সাধারণ বা অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষগুলোরও হাসি-আনন্দ-প্রেম আছে, আছে সৌন্দর্যের আকর্ষণ, পরস্পরের মনোরঞ্জন। সেকারণে বেদে মেয়েরা তাদের বহরের কোন ছেলেকেই বিয়ে করে থাকে। বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিবাহ বিচ্ছেদ এবং বিধবা বিবাহের প্রচলন আছে বেদে সমাজে। তবে তাদের স্বামী পরিবর্তনই বেশি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা স্বয়ংবরা। তবে পারিবারিক কলহ-বিবাদ মিমাংসা করা সর্দারের কাজ। বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারা ঠেরভাষী। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা ঠেরভাষা ব্যবহার করে। বিশেষ করে গাঁয়ে বাণিজ্য করার সময়। ইদানীং বাইদ্যানীদেরকে শহরের রাস্তায় দলবেধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পথ আগলে ধরে পথিকের। সাহায্য চায় জবরধস্তিতে। মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোণার খালিয়াজুরি, শাল্লা, দিরাই, সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহের কিছু কিছু অঞ্চলে বাইদ্যা-বাইদ্যানীদের বেদে বহর দেখা যায়। কালের যাত্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে সমাজের নিচু শ্রেণির এই বেদে সম্প্রদায়। বেদে বহর খুব বেশি চোখে পড়ে না।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর