বড়গাছদের ছেড়ে সরকার ডালপালার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে

বহুল আলোড়িত কথিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নিয়ে বিতর্কের নতুন ঝড় উঠেছে। দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদকের সে সময় শেখ হাসিনার দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদের ব্যাপারে ‘ভুল স্বীকার’কে কেন্দ্র করে ওঠা এই বিতর্ক নানাদিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তো বটেই, উঠে আসছে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকের সম্পাদকদের ভূমিকার কথাও। আলোচনা ও সমালোচনায় উঠে আসছে সে সময় মাইনাস টু ফর্মুলার সঙ্গে জড়িত কুশীলবদের প্রসঙ্গও।

এই স্বীকারোক্তির পর থেকেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে মাহফুজ আনামের শাস্তি দাবি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৬টিরও বেশি মামলা হয়েছে। ৮২ হাজার ৬৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। এমনকি এই মামলা দাযের অব্যাহত রয়েছে।

এ নিয়ে পূর্বপশ্চিমের কথা হয় দেশের তিন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে।

তারা মনে করছেন, ওয়ান ইলেভেন মাহফুজ আনামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকার গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।

তারা আরও বলছেন, এক এগারোর সময় বড় বড় কুশীলবরা চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। অথচ তাদেরকে বাদ দিয়ে সরকার মাহফুজ আনামদের মতো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লেগেছেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য বড় বাধাও।

ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

‘সরকার মস্তবড় গাছপালা ছেড়ে ডালপালার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। ১/১১ এর মূল হোতা অনেকেই ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা ও সরকারের বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলক। এটা একজন সম্মানীত ব্যক্তিকে হয়রানী করার নামান্তর।’

‘আওয়ামী লীগের অনেকেই ওই সময় বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা এখন এমপি-মন্ত্রী হয়ে রাজার হালে আছেন। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান ক্ষুন্ন করার চক্রান্ত করছে। এটা দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।’

‘মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সরকার মূলত গণমাধ্যমকে আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে যাতে একটি লোকও কথা বলতে না পারেন, কোনো সংবাদ মাধ্যম যাতে কিছু লিখতে না পারে সেজন্য সরকার উঠে-পড়ে লেগেছে। এর মাধ্যমে সরকার তার অবৈধ ক্ষমতাকে আরো চিরস্থায়ী করতে চায়।’

‘সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, দেশে ‘গণ’ ও ‘তন্ত্র’ কোনোটাই নেই। সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনের নামে প্রহসন বন্ধ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, জনগণের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করুন। অহেতুক কোনো জনগণকে হয়রানি বন্ধ করুন। নইলে এর ফলাফল দেশ ও জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।’

মো. হাফিজ উদ্দিন খান
তত্ত্বাববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

‘এক এগারোর কুশীলব তো অনেকেই ছিলেন। তাদের বাদ দিয়ে সরকার মাহফুজ আনামকে নিয়ে কেন টানা-হেঁচড়া করছেন? সরকার এর মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্য সফল করতে চাচ্ছে তা আমার বুঝে আসে না।’

‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই বলেছিলো, ১/১১ সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। তাহলে কেনো আবার সেই আমলের কর্মকাণ্ড নিয়ে রাজনীতিক মাঠ গরম করা। এতদিন তো কেউ বলেননি, মাহফুজ আনাম ওই সময়ে সংবাদ ছাপিয়ে অপরাধ করেছেন। আট বছর পরে এই প্রসঙ্গ টেনে এনে সরকার কি করতে যাচ্ছে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এটা বুঝি, সরকার সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করে তাদের ক্ষমতাকে অবৈধভাবে আরো দীর্ঘস্থায়ী করতে চাচ্ছে হয়তো।’

‘সরকার প্রথম আলো ও ডেইলী স্টারকে ধ্বংসের চক্রান্ত করছে। এর মাধ্যমে অন্যসব মিডিয়াকে বার্তা দিচ্ছে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে যাতে দেশে কথা বলার কোনো লোকই না থাকে সেজন্যই মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে প্রথম আঘাতটি হানতে চাচ্ছে।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক

‘মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রহসনমূলক মামলা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হয়রানী মূলক বক্তব্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

‘এতদিন সরকার বা জনগণ কেউ তো বলেন নি, মাহফুজ আনাম ভুল তথ্য ছাপিয়েছেন। মূলত সরকার তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এ বিষয়টি বোঝাতে চাচ্ছে, দেশে কোনো প্রতিবাদী কণ্ঠ থাকতে পারবে না।’

‘দেশে যদি কথা বলার কোনো লোক না থাকে তবে উগ্র মতবাদের অনুসারীরাই সেই শুন্যস্থান পুরণ করবে। সরকার সেটাই চাচ্ছে, যাতে তারা বেশিদিন ক্ষমতায় থেকে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে।’

‘ওই সময় সংবাদ তো আরো বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে তো কোনো কথা উঠছে না। সরকার বড় পত্রিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্যসব গণমাধ্যম নাগালের মধ্যে থাকবে এজন্য মাহফুজ আনাম ও ডেইলী স্টারের বিরুদ্ধে নেমেছেন।’

‘সরকারের উদ্দেশে বলতে চাই, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখুন। স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া একটি দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়টি নিশ্চিত করুন। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করে সাময়িক লাভবান হওয়া সম্ভব। কিন্তু চিরস্থায়ী ভাবে কোনো সফলতা আসে না।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর