ঢাকা ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পানিশূন্য তিস্তা : হাহাকারে হাজারো জেলে, মাঝি ও কৃষক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১৯:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
  • ৪৬৪ বার

চিরযৌবনা তিস্তা নদী এখন মরা খাল।এতে এখন আর নেই বাঁধ ভাঙা স্রোত আর মন মাতানো ঢেউ। নদীর বুকে এখন আর ভেসে বেড়ায় না তিস্তানির্ভর মাঝি, জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। নৌকাগুলো পড়ে আছে নদীর বুকে ভেসে ওঠা বালু চরে। পানির অভাবে তিস্তা তার আসল রুপ হারিয়ে যেন মধ্য-প্রাচ্যের মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখন তিস্তা ব্যারেজটি দাঁড়িয়ে আছে শুধুই বালু চরে।

ভারতীয় কাঁটাতার ঘেঁষা উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম এই সেচ প্রকল্পটি। এ অঞ্চলের হাজারো কৃষক, জেলে ও মাঝি পরিবারের জীবিকার একমাত্র চালিকা শক্তি এ তিস্তা নদী।

ভারত উজানের গজঁল ডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে তিস্তা এখন মৃত প্রায়। তাই তিস্তা ব্যারেজের উজানে ও ভাটি অঞ্চলের হাজারো জেলে, কৃষক ও মাঝি এখন হাহাকার করছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, চিরযৌবনা তিস্তা নদীর দুর্দশার করুণ চিত্র। পানি শুকিয়ে তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বিশাল বালুচর। মাঝিরা বালু চরে পড়ে থাকা নৌকার সামনে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে চেয়ে আছেন ব্যারেজের দিকে। এই বুঝি তেড়ে আসবে পানি। ভরে যাবে নদী। এছাড়া নদীতে পানিও নেই; মাছও নেই। যতটুকু পানি আছে, তাতে মাছের ছোট ছোট পোনা আর ব্যাঙের বাচ্ছা ছাড়া কিছুই থাকার কথা নয়। তাই জেলেরা নদীর তীরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন আর কেউ কেউ বালুচরে জাল শুকাতে দিয়ে সেখানেই পরম শান্তির ঘুমে ঢলে পড়েছেন।

পাশেই আর এক জেলে বালুর ওপর বসে সুই সুতা দিয়ে ছেড়া জাল ঠিক করছেন। আর এসব চিত্র দেখে নদীর তীরে বসে হতাশা আর চিন্তাগ্রস্ত মনে ভাবছেন তিস্তার পানির জন্য হাহাকার করা কৃষক রহমত আলী। আজ বড় অসহায় কৃষক রহমত আলীর মতো এ তিস্তানির্ভর মানুষগুলো।

কৃষক রহমত আলীর বাড়ি ব্যারেজ এলাকার দোয়ানীতে। স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তার ৬ সদস্যের সংসার। এত চিন্তিত মনে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তিনি চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এবার নদীতে পানি না থাকায় শ্যালো মেশিন দিয়ে আবাদি জমিতে পানি সেচ দিতে বিঘাপ্রতি তার ৪-৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। যেখানে বিঘাপ্রতি ৫ হাজার টাকা হলেই হতো। এখন মোট ১০ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি খরচ করতে হয়েছে।

তিনি আরও জানান, জমি চাষের জন্য তিনি মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। ফলে ফসলের ফলন ভালো না হলে ঋণ শোধ করবেন কি করে? আর সংসার চালাবেন কি করে এখন সেই দুশ্চিন্তা তাকে সব সময় তাড়া করছে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ তো আছেই।

এমনই দুঃখ-দুর্দশার কথা বললেন আরেক কৃষক তিস্তার বাম তীরে অবস্থিত গড্ডিমারী গ্রামের আজগর আলী। ব্যারেজের সামনে হাঁটু পানিতে দর্শনার্থীদের জন্য চলে দুটি নৌকা। কথা হয় রনৗকার মাঝি ফারহাজের সঙ্গে।

তিনি জানান, ওই এলাকার চাতুনামা চরের বাসিন্দা। স্ত্রী ও দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। দীর্ঘ ১৫ বছর থেকে তিনি এ পেশায়। ব্যারাজে ঘুরতে আসা মানুষকে নৌকায় চড়িয়ে দিন ৪০০-৫০০ টাকা আয় হতো তার। ভালোই চলতো সংসার। কিন্তু টানা কয়েক বছর থেকে এই শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। তাই আগের মতো তেমন আয়ও হয় না। এখন সারাদিন খেটে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। এতে দু-এক বেলা খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে। অভাবের তাড়নায় ঋণের বোঝাও এখন তার মাথার উপরে।

সোলেমান আলী নামে এক জেলে বলেন, যদি তিস্তার এ পানির সমস্যা দ্রæত সমাধান হয়, তাহলে জেলে, মাঝি ও হাজার হাজার কৃষককে দুর্দশার মধ্যে পড়তে হবে না।

তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এ তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান করুন। তাহলে তিস্তা নদী ফিরে পাবে তার আসল রূপ। অভাব-অনটন, দু:খ-দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা পাবে তিস্তা পাড়ের জেলে, মাঝি ও হাজার হাজার কৃষক- এমনটাই আশা এ তিস্তা পাড়ের মানুষের।

তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান পূর্বপশ্চিমকে জানান, যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন, সে পরিমাণ পানি তিস্তা নদীতে নেই। যতটুকু আছে, তা দিয়ে সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা জেলায় সেচ দেয়া দুস্কর। তবে তিস্তায় পানি এলে সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা জেলায় সুষ্ঠুভাবে পানি বণ্টন করা হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

পানিশূন্য তিস্তা : হাহাকারে হাজারো জেলে, মাঝি ও কৃষক

আপডেট টাইম : ১১:১৯:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

চিরযৌবনা তিস্তা নদী এখন মরা খাল।এতে এখন আর নেই বাঁধ ভাঙা স্রোত আর মন মাতানো ঢেউ। নদীর বুকে এখন আর ভেসে বেড়ায় না তিস্তানির্ভর মাঝি, জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। নৌকাগুলো পড়ে আছে নদীর বুকে ভেসে ওঠা বালু চরে। পানির অভাবে তিস্তা তার আসল রুপ হারিয়ে যেন মধ্য-প্রাচ্যের মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখন তিস্তা ব্যারেজটি দাঁড়িয়ে আছে শুধুই বালু চরে।

ভারতীয় কাঁটাতার ঘেঁষা উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম এই সেচ প্রকল্পটি। এ অঞ্চলের হাজারো কৃষক, জেলে ও মাঝি পরিবারের জীবিকার একমাত্র চালিকা শক্তি এ তিস্তা নদী।

ভারত উজানের গজঁল ডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে তিস্তা এখন মৃত প্রায়। তাই তিস্তা ব্যারেজের উজানে ও ভাটি অঞ্চলের হাজারো জেলে, কৃষক ও মাঝি এখন হাহাকার করছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, চিরযৌবনা তিস্তা নদীর দুর্দশার করুণ চিত্র। পানি শুকিয়ে তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বিশাল বালুচর। মাঝিরা বালু চরে পড়ে থাকা নৌকার সামনে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে চেয়ে আছেন ব্যারেজের দিকে। এই বুঝি তেড়ে আসবে পানি। ভরে যাবে নদী। এছাড়া নদীতে পানিও নেই; মাছও নেই। যতটুকু পানি আছে, তাতে মাছের ছোট ছোট পোনা আর ব্যাঙের বাচ্ছা ছাড়া কিছুই থাকার কথা নয়। তাই জেলেরা নদীর তীরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন আর কেউ কেউ বালুচরে জাল শুকাতে দিয়ে সেখানেই পরম শান্তির ঘুমে ঢলে পড়েছেন।

পাশেই আর এক জেলে বালুর ওপর বসে সুই সুতা দিয়ে ছেড়া জাল ঠিক করছেন। আর এসব চিত্র দেখে নদীর তীরে বসে হতাশা আর চিন্তাগ্রস্ত মনে ভাবছেন তিস্তার পানির জন্য হাহাকার করা কৃষক রহমত আলী। আজ বড় অসহায় কৃষক রহমত আলীর মতো এ তিস্তানির্ভর মানুষগুলো।

কৃষক রহমত আলীর বাড়ি ব্যারেজ এলাকার দোয়ানীতে। স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তার ৬ সদস্যের সংসার। এত চিন্তিত মনে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তিনি চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এবার নদীতে পানি না থাকায় শ্যালো মেশিন দিয়ে আবাদি জমিতে পানি সেচ দিতে বিঘাপ্রতি তার ৪-৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। যেখানে বিঘাপ্রতি ৫ হাজার টাকা হলেই হতো। এখন মোট ১০ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি খরচ করতে হয়েছে।

তিনি আরও জানান, জমি চাষের জন্য তিনি মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। ফলে ফসলের ফলন ভালো না হলে ঋণ শোধ করবেন কি করে? আর সংসার চালাবেন কি করে এখন সেই দুশ্চিন্তা তাকে সব সময় তাড়া করছে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ তো আছেই।

এমনই দুঃখ-দুর্দশার কথা বললেন আরেক কৃষক তিস্তার বাম তীরে অবস্থিত গড্ডিমারী গ্রামের আজগর আলী। ব্যারেজের সামনে হাঁটু পানিতে দর্শনার্থীদের জন্য চলে দুটি নৌকা। কথা হয় রনৗকার মাঝি ফারহাজের সঙ্গে।

তিনি জানান, ওই এলাকার চাতুনামা চরের বাসিন্দা। স্ত্রী ও দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। দীর্ঘ ১৫ বছর থেকে তিনি এ পেশায়। ব্যারাজে ঘুরতে আসা মানুষকে নৌকায় চড়িয়ে দিন ৪০০-৫০০ টাকা আয় হতো তার। ভালোই চলতো সংসার। কিন্তু টানা কয়েক বছর থেকে এই শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। তাই আগের মতো তেমন আয়ও হয় না। এখন সারাদিন খেটে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। এতে দু-এক বেলা খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে। অভাবের তাড়নায় ঋণের বোঝাও এখন তার মাথার উপরে।

সোলেমান আলী নামে এক জেলে বলেন, যদি তিস্তার এ পানির সমস্যা দ্রæত সমাধান হয়, তাহলে জেলে, মাঝি ও হাজার হাজার কৃষককে দুর্দশার মধ্যে পড়তে হবে না।

তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এ তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান করুন। তাহলে তিস্তা নদী ফিরে পাবে তার আসল রূপ। অভাব-অনটন, দু:খ-দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা পাবে তিস্তা পাড়ের জেলে, মাঝি ও হাজার হাজার কৃষক- এমনটাই আশা এ তিস্তা পাড়ের মানুষের।

তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান পূর্বপশ্চিমকে জানান, যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন, সে পরিমাণ পানি তিস্তা নদীতে নেই। যতটুকু আছে, তা দিয়ে সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা জেলায় সেচ দেয়া দুস্কর। তবে তিস্তায় পানি এলে সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা জেলায় সুষ্ঠুভাবে পানি বণ্টন করা হবে।