হাওর বার্তা ডেস্কঃ গ্লুকোমা হলো চোখের একপ্রকার রোগ, যাতে অপটিক স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও চোখ অন্ধ হয়ে যায়। গ্লুকোমাজনিত অন্ধত্বের কোনো প্রতিকার নেই, প্রতিরোধই একমাত্র উপায়।
সারা বিশ্বে প্রায় ৮০ মিলিয়ন লোক অন্ধত্ব নিয়ে জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে গ্লুকোমাজনিত কারণে অন্ধ লোকের সংখ্যা প্রায় ৮ মিলিয়ন। এর এক বিরাট অংশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর ২ দশমিক ৮ ভাগ গ্লুকোমায় আক্রান্ত। এ ছাড়া এ রোগের ঝুঁকিতে আছে জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশ মানুষ।
গ্লুকোমা রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে এক বিরাট জনগোষ্ঠী অপরিবর্তনযোগ্য অন্ধত্বের শিকার হন, যা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করতে পারলে প্রতিরোধ করা সম্ভব। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক গ্লুকোমা রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে-
গ্লুকোমা কী?
গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ, যাতে চোখের স্নায়ু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এমনকি এতে একসময় রোগী সারা জীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। তবে সময়মতো ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করলে এ অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরীণ উচ্চচাপ এর জন্য দায়ী।
কেন গ্লুকোমা রোগ হয়?
গ্লুকোমা রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অদ্যাবধি চোখের উচ্চচাপই এ রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেয়া হয়। তবে স্বাভাবিক চাপেও এ রোগ হতে পারে। সাধারণত চোখের উচ্চচাপই ধীরে ধীরে চোখের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দৃষ্টিকে ব্যাহত করে। তবে কিছু কিছু রোগের সঙ্গে এ রোগের গভীর সম্পর্ক লক্ষ করা যায় এবং অন্যান্য কারণেও এ রোগ হতে পারে। যেমন- পরিবারের অন্য কোনো নিকটাত্মীয়ের এ রোগ থাকা।
>> উচ্চবয়স (চল্লিশোর্ধ্ব)।
>> ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ।
>> মাইগ্রেন নামক মাথাব্যথা।
>> রাত্রিকালীন উচ্চরক্তচাপের ওষুধ সেবন।
>> স্টেরোইড নামক ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করা।
>> চোখের ছানি অপারেশন না করলে বা দেরি করলে।
>> চোখের অন্যান্য রোগের কারণে।
>> জন্মগত চোখের ত্রুটি ইত্যাদি।
গ্লুকোমা রোগের লক্ষণ কী?
অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এ রোগের কোনো লক্ষণ অনুধাবন করতে পারেন না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার সময় হঠাৎ করেই চিকিৎসক এ রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিম্নের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন-
>> ঘন ঘন চশমার গ্লাস পরিবর্তন হওয়া।
>> চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা।
>> ঘন ঘন মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হওয়া।
>> দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে কমে যাওয়া বা দৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাপ্তি কমে আসা। অনেক সময় চলতে গিয়ে দরজার পাশে বা অন্য কোনো পথচারীর গায়ে ধাক্কা লাগা।
>> মৃদু আলোয় কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
>> ছোট ছোট বাচ্চার অথবা জন্মের পর চোখের কর্নিয়া ক্রমাগত বড় হয়ে যাওয়া বা চোখের কর্নিয়া সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি।
গ্লুকোমা রোগের চিকিৎসা
গ্লুকোমা রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, কিন্তু নিরাময় সম্ভব নয়। ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপের মতো এ রোগের চিকিৎসা সারা জীবন করে যেতে হবে। এ রোগে দৃষ্টি যতটুকু হ্রাস পেয়েছে, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে দৃষ্টি যাতে আর কমে না যায়, তার জন্য আমাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। এ রোগে প্রচলিত তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে
এক. ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা
দুই. লেজার চিকিৎসা
তিন. শৈল্য চিকিৎসা বা সার্জারি
যেহেতু চোখের উচ্চচাপ এই রোগের প্রধান কারণ, তাই ওষুধের দ্বারা চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। একটি ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে একাধিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া তিন মাস পরপর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে এ রোগের নিয়মিত কতগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না। যেমন-
>> দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা।
>> চোখের চাপ পরীক্ষা।
>> দৃষ্টিব্যাপ্তি বা ভিজুয়াল ফিল্ড পরীক্ষা।
>> চোখের নার্ভ পরীক্ষা।
এই রোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করা এবং সময় মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা ও তার পরামর্শ মেনে চলা। যেহেতু অধিকাংশ রোগীর চোখে কোনো ব্যথা হয় না, এমনকি তেমন কোনো লক্ষণ অনুভূত হয় না, তাই রোগী নিজে, এমনকি রোগীর আত্মীয়স্বজনরাও এ দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা অব্যাহত রাখেন না। ফলে অনেক রোগী অকালে অন্ধত্ববরণ করে থাকেন। ওষুধ ছাড়াও গ্লুকোমার অন্যান্য চিকিৎসা রয়েছে, যার সিদ্ধান্ত প্রয়োজনে বা সময় মতো চিকিৎসক গ্রহণ করতে পারেন। যেমন- লেজার চিকিৎসা এবং শল্য চিকিৎসা। যার দ্বারা এই রোগে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব।
গ্লুকোমা রোগে রোগীর করণীয়
>> চিকিৎসক রোগীর চক্ষু পরীক্ষা করে তার চোখের চাপের মাত্রা নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন, তা নিয়মিত ব্যবহার করা।
>> দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে, তাই নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
>> সময় মতো চোখের বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখা যে, তার গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণে আছে কি না।
>> পরিবারের সবার চোখ পরীক্ষা করে গ্লুকোমা আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া।
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। ঠিক মতো ওষুধ ব্যবহার করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে একজন গ্লুকোমা রোগী তার স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে পারেন।
পরিশেষে মনে রাখবেন, গ্লুকোমা অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ, যার কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে আপনার চক্ষু পরীক্ষা করে চোখের চাপ জেনে নিন। গ্লুকোমা প্রতিরোধ করুন, অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকুন। আপনার পরিবারের সবাইকে নিয়ে, সুন্দর দৃষ্টিশক্তি নিয়ে, পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করুন।