হাওর বার্তা ডেস্কঃ কয়েক দিন ধরে যে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তার ধাক্কা লেগেছে রাজধানী ঢাকায়ও। আর এই ধাক্কাটা যেন নগরীর ছিন্নমূল মানুষের কাছে আরও কয়েক গুন বেশি হয়ে ধরা দেয়। ঢাকা শহরে কিছু লোক রাস্তায় থাকে। শীত বেড়ে গেলে তাদের তা প্রতিরোধ করে থাকার তেমন প্রস্তুতিও নেই। তাই তাদের শীতের পিঠেপুলি খাওয়ার আনন্দ তো নেই, তাদের কাছে আছে বিষাদের শীত।
রাত সোয়া ৮টা, রাজধানীর কাওরান বাজারের ফুটপাত। সেখানে এক শিশুকে নিয়ে শুয়ে আছেন এক নারী। একটুকরো পলিথিন ইট দিয়ে আটকে ময়লা নোংরা চাদরে শিশুকে জড়িয়ে পাশেই কাগজ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছেন। আগুনের কাছে আর কয়েক জন শিশু আর যুবক বসা। তারা সবাই এলাকায় হকার। কংক্রিটের এই নগরীতে ফুটপাতেই তাদের বসতি। পাশেই তিন জনের আর এক পরিবার শুয়ে আছে। শুধু পুরুষটি আগুনের একটু দূরে বসা। শীত নিয়ে প্রশ্ন করলে জানায়, তিন জনের এই পরিবারের শীত নিবারণের পুরনো ছেঁড়া একটা কম্বল আছে। বাড়ি থেকে আসার সময় তার পরিবার তা নিয়ে আসে। এখানে এসে তাদের বাচ্চা হয়। তিন বছর কেটে যায়। পেটের খাবার জোটে না, বাড়তি গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। তিন জনের এই কম্বলে শীত নিবারণ সম্ভব নয়। তার পরও এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে আগুন আর ছেঁড়া কম্বলের বদলৌতে।
খোলা আকাশের নিচে শীতের সঙ্গে লড়াই করে বাস করছেন জরিনা। হাইকোর্টের সামনে রাস্তায় বাস করেন। অনেক বছর দরে এখানেই তার সংসার। জামালপুরের সিদ্দিককে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। স্বামী পান সিগারেট বিক্রি করেন। এতে সংসার চলে গেলেও শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় কেনা সম্ভব হয় না। বিয়ের আগে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় কাজ করতেন জরিনা। সেখানে বিবি সাহেব তাকে উলের কাপড় দেন। তাই আজ অবধি তা-ই ব্যবহার করছেন। আর হাইকোর্টের মাজারে একবার গরম কাপড় পেয়েছিলেন। ঠাণ্ডায় তাদের কতটা কষ্ট হচ্ছে তা জানিয়ে বলেন, ‘এই শীতের মধ্যে আমরা অনেক কষ্ট করছি। কোনো কিছু পাই নাই। এভাবেই শীত কাটাচ্ছি। অনেক জায়গার কম্বল দেওয়া হয়, তারা শুনতে পান, কিন্তু একটাও পান না। শীতের কোনো কাপড়চোপড় নেই।
কার্জন হল আর আনোয়ার পাশা আবাসিক এলাকার রাস্তার পাশে ছেঁড়া কাঁথা আর ময়লা চাদর গায়ে দিয়েই শুয়ে সারি সারি মানুষ। গলা অবধি চাদর টানা। তাদের গভীর ঘুমের পাশেই হর্ন বাজিয়ে চলছে যানবাহন। এখানেও শীত নিবারণে জন্য আগুন জ্বালানো হয়েছে। তাদেরই একজন মনির। বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি জানান, রাতে কাজ করে সকালে ঘুমান। কম্বল কিংবা শীত নিবারণের কোনো উপকরণ নেই তার। তাই কষ্টও হয় ভীষণ। সেখানকার বাসিন্দা আকলিমা বেগম। শীত নিবারণের তার তেমন প্রস্তুতি নেই। পলিথিনের তৈরি ছোট্ট ঘরে শুয়ে আছে ছেলে-মেয়ে। মাঝেমধ্যে তারা আবর্জনা পোড়া দিয়ে নিজেদের শীত প্রতিরোধ করেন। আকলিমা জানান, আগুন জ্বালালে ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। এতে শীত কমলেও আগুন লাগার ভয়ও থাকে। শীতে দিন কোনোমতে পার হলেও রাতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। কারণ শীতের কোনো লেপ নেই, কম্বল নেই, নেই কাঁথা।
শীতে এমন চিত্র দেখা যায় রাস্তায় বাস করা মানুষের মধ্যে। যারা কমলাপুর রেল স্টেশন, দোয়েল চত্বর-সংলগ্ন ফুটপাত, শহিদ মিনার, হাইকোর্ট সংলগ্ন ফুটপাত, লঞ্চঘাট, মহাখালী বাস টার্মিনাল, সায়দাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস করে। ঢাকায় খোলা আকাশের নিচে কী পরিমাণ মানুষ বাস করে তার স্পষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে গত আট বছর ধরে শহুরে ছিন্নমূলদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন সাজিদা ফাউন্ডেশনের হিসেবে ২০ হাজারের মতো মানুষ আছে যাদের ঘরবাড়ি কিছু নেই।